ভারতের গাজলডোবা গেটের সবকটি গেট খুলে দেয়ায় উজানের পানি আছড়ে পড়েছে তিস্তার বাংলাদেশের ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যা আকস্মিক বন্যায় রূপ নিয়েছে। ধরলা, ব্রক্ষপুত্রেরও একই অবস্থা। ফলে তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রক্ষপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চরাঞ্চল ছাড়াও নদী তীরবর্তী নি¤œাঞ্চল এবং চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। হাজার হাজার হেক্টর জমির বাদাম, ভুট্টা, পাট ও বোরোধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শতশত পুকুর তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সাথে সমানতালে চলছে ভাঙন। পানি বৃদ্ধি হতে থাকলে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে এই অববাহিকা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর পরপরই বাড়তে থাকে পানি প্রবাহ। রাত সাড়ে ৯টায় পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার), রাত ১০টায় ৫২ দশমিক ৮৩ বিপৎসীমার ২৩ এবং রাত ১১টায় ৫২ দশমিক ৯০ যা বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। ব্যারেজ রক্ষায় ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার এবং বুধবার ৩০ সেন্টিমিটার নিচে ছিল তিস্তা নদীর পানি।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে ২০ এবং ৯টায় ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাড়তে থাকে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে। সকাল ১০টায় বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ২০ সেন্টিমিটার ছুঁইছুঁই করলেও ১১টায় তা বিপৎসীমা অতিক্রম করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা আরো জানান, গজলডোবার সবকটি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে উজানে উজানে ভয়াবহ রকম পানি বৃদ্ধি পায়। এ কারণে ভাটিতে পাঁচ জেলার ১৪ উপজেলায় তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। এ ছাড়া তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানের বাঁধে আঘাত করছে। ফলে বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন নয়া দিগন্তকে জানান, ডাউয়াবাড়ি নামক স্থানে তিস্তা ডানতীর বাঁধে তিস্তার পানি আঘাত হানছে। সেখানে বালির বস্তা ফেলানো হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরেজমিনে পাওয়া তথ্যে মতে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে এরকম পরিস্থিতিতে এই ৫ জেলার চরাঞ্চলের ২২৫টি গ্রামে বন্যার পানি ঢোকে ও প্রায় ২ লাখ মানুষ প্লাবিত হয়। ইতোমধ্যেই চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ রাতের বেলা বাড়িঘরে পানি উঠে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। রাতের আঁধারেই চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলগুলো থেকে মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে চলে যাচ্ছেন। অনেকেই কিছুই নিতে পারেননি।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের রাস্তা, ব্রিজ ভেঙে চরসহ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর ও মৎস খামারের মাছ। পানিবন্দি পরিবারগুলো ছোট শিশু, বৃদ্ধ ও গরু, ছাগল, হাস-মুরগী নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয় স্বজনদের দেয়া ও শুকনো খাবারই একমাত্র ভরসা পানিবন্দিদের। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। টয়লেট করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব জানিয়েছেন, হঠাৎ রাস্তায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা এবং প্রকল্প কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। যারা পানিবন্দি হয়ে পড়বেন তাদের দ্রুতগতিতে উঁচু স্থানে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন তারা। পানিবন্দি মানুষের তাৎক্ষণিকভাবে খাবারও দেয়ার ব্যবস্থা করবেন তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড়ি ঢল এবং ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বন্যা দেখা দিবে এই অঞ্চলে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত আছি।