খুলনা বিভাগে করোনায় আরো ৩২ জনের প্রাণহানি
খুলনা বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমেছে। এ সময়ে বিভাগে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৯৭ জনের। এর আগে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) বিভাগে ৪৭ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৬৩৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। গতকাল শুক্রবার (১৬ জুলাই) বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা জেলায়। বাকিদের মধ্যে কুষ্টিয়ায় সাতজন, যশোর ও মেহেরপুরে চারজন করে, নড়াইলে তিনজন, বাগেরহাট ও ঝিনাইদহে দুজন করে এবং চুয়াডাঙ্গা একজন মারা গেছেন। খুলনা বিভাগের মধ্যে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চুয়াডাঙ্গায় গত বছরের ১৯ মার্চ। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে আজ সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৮০৪ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫০ হাজার ৭১১ জন।
খুলনায় করোনার প্রকোপ বাড়ার নেপথ্যে: করোনা সংক্রমণরোধে সচেতনতা এখন ‘উচিত’-এ আটকে রয়েছে। অনেকেই বলেন, করোনা থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু যারা এই কথা বলেন, তারাই মাস্ক পরেন না। এমন প্রকৃতির লোকই আবার মন্তব্য করছেনÍমাস্ক পরলে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই করোনা হওয়ার আগে মাস্ক পরে শ্বাসকষ্টে মরতে চান না।
এমন অসচেতনতা ও উদাসীনতার কারণে খুলনা বিভাগে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত বাড়ছে। সংক্রমণের শুরু থেকে শুক্রবার (১৬ জুলাই) সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় শনাক্ত ৭৯ হাজার ৫৩৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন মোট এক হাজার ৮০৪ জন। ৫০ হাজার ৭১১ জন সুস্থ হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত আরও ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে এক হাজার ৪৯৭ জনের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার খুলনা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় ৪৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। একই সময়ে এক হাজার ৬৩৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। বুধবার (১৪ জুলাই) বিভাগে ৩৬ জন মারা যান। করোনা শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৬২১ জনের। খুলনা বিভাগে করোনার প্রকোপ ঠেকানো যাচ্ছে না। সংক্রমণরোধে অপ্রয়োজনে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে কঠোর লকডাউনে মাঠে নামে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ কোস্ট গার্ড, নৌ বাহিনী। এরপরও সড়কে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। কঠোর লকডাউনের প্রথম আট দিন দেখা যায়, খুলনা বিভাগে ৮ জুলাই ৫১ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৭৩২; ৭ জুলাই সর্বোচ্চ ৬০ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৯০০; ৬ জুলাই ৪০ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৮৬৫; ৫ জুলাই ৫১ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৪৭০; ৪ জুলাই ৪৬ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৩০৪; ৩ জুলাই ৩২ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৫৩৯; ২ জুলাই ২৭ জনের মৃত্যু, শনাক্ত এক হাজার ২০১ এবং ১ জুলাই ৩৯ জনের মৃত্যু ও শনাক্ত হয়েছেন ২৪৫ জন।
কঠোর লকডাউনের শুরুতে বিকালের পর বাজার বন্ধ হয়ে যেতো। আর মূল সড়কে লোকসমাগমও কম ছিলো। কিন্তু আট দিনের মাথায় এসে দেখা যায়, প্রশাসনের কঠোরতা মধ্যেও সন্ধ্যার পর মহানগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এক শ্রেণির হকার ভ্যানে করে সবজি, কাপড়সহ নানা ধরনের পণ্য নিয়ে নির্বিঘেœ ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এসব দোকানে জনসমাগম হয়।
মাস্ক ছাড়াই লোকজনকে চলাফেরা করতে দেখা যায়। পাড়া-মহল্লায় চলে আড্ডা। কিন্তু আড্ডায় থাকা মানুষগুলো মাস্ক ব্যবহার করেন না। মাস্ক না পরা এসব মানুষ মনে করেন, অবশ্যই মাস্ক পরা উচিত। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারে কোনও আগ্রহ নেই।
গোবরচাকা এলাকার ৫৫ বছর বয়সী আব্দুর রহমান বলেন, মাস্ক ব্যবহার করে আড্ডায় কথা বলা ও হাসি-তামাশা জমে না। আর মাস্ক পরলে শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা হয়। তাই মাস্ক পরা হয় না।
মোশারফ হোসেন নামে আরেকজন বলেন, করোনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, বা করোনা রয়েছে এমন লোকদের থেকে করোনা ছড়ানোর ভয় কাজ করে না। তবে, বাতাসে করোনার জীবাণু রয়েছে। তাই বাতাস থেকে যাতে জীবাণু নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য মাস্ক পরা উচিত।
কিন্তু আপনি কেন মাস্ক পরেননিÍজানতে চাইলে তিনি বলেন, মাস্ক পরলে শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। তাই করোনা হওয়ার আগেই মাস্ক পরে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরতে চাই না।
লোকজন এখন অনেক বেশি সচেতন। এখন প্রতি ১০ জনে সাতজনই মাস্ক পরছেন বলে দাবি করেন খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক রাশেদা সুলতানা।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রশাসনের চেষ্টার কোনও ঘাটতি নেই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে জনসচেতনতা অনেক বেড়েছে। আগের অসচেতনতার ফলই হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি বেড়ে যাওয়ার বর্তমান রূপ। তবে, ধৈর্য ধরতে হবে। লকডাউনের ফলে সৃষ্ট সচেতনতার সুফল শিগগিরই আমরা দেখতে পাবো।
খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, করোনার ঊর্ধ্বমুখী অবস্থার কারণেই লকডাউন ঘোষণা করা হয়। খুলনায় দুই সপ্তাহের লকডাউনের ফলে পরিস্থিতির আর অবনতি হয়নি। স্থির অবস্থাতেই রয়েছে। প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আমাদেরকে আরও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। খুলনায় কঠোর লকডাউনে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে না। সেই সঙ্গে নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা ইউনিটে মৃত্যুও থামছে না। করোনা ইউনিটে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। খুলনার সরকারি-বেসরকারি চারটি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ও উপসর্গে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ জন করোনা আক্রান্ত ছিলেন। আর অন্যরা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এদিকে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও ঈদুল আজহা উপলক্ষে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি। কিন্তু সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না। ট্রাকসেল ঘিরে ব্যাপক জনসমাগম, যারা গাদাগাদি করে অবস্থান নেয়। আর সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ লাইন।
খুলনা মহানগরীর ময়লাপোতা মোড়, শিববাড়ী মোড়, দৌলতপুর, খালিশপুর, নিরালা মোড় ও জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকাসহ ১০টি স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রি হয়। বাজার দরের তুলনায় এ পণ্যের দাম কম হওয়ায় ক্রেতা সমাগম বেশি থাকে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষিত হচ্ছে। কোনও ধরনের সামাজিক দূরত্ব নেই। ক্রেতা-ক্রেতারা মাস্কও ব্যবহার করেন না।
ময়লাপোতা মোড়ে টিসিবির পণ্য ক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, সবাই তাড়াহুড়ো করে আগে পণ্য কেনার জন্য গাদাগাদি করে দাঁড়ান। কেউ কাউকে কিছু বলেও না। ক্রেতা সালমা বেগম বলেন, আগেভাগে পণ্য কেনার জন্য সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আর স্বাস্থ্যবিধির কথা মনে থাকে না। আগে পণ্য কিনতে ব্যস্ত থাকায় সামাজিক দূরত্বও থাকে না। মুখে মাস্কও থাকে না।
ব্যবসায়ী জুুয়েল বলেন, লকডাউনের প্রথম দিন বেশ কঠোরতা ছিল। কারণ জনমনে সেনাবাহিনীর আতঙ্ক ছিলো। কিন্তু দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাসড়কে জনসমাগম ও যানবাহনও বাড়তে থাকে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, করোনাভাইরাসের প্রকোপ অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রতিদিনই মৃত্যু বাড়ছে। তবুও জনগণ সচেতন হচ্ছে না। মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। খুলনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ বশাক বলেন, কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে প্রশাসন সকাল সন্ধ্যা নিরলসভাবে কাজ করেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানার অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তারপরও কেউ সচেতন হচ্ছে না।