সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পূর্বাহ্ন

ঈদুল আজহার পশু কেনা-বেচা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি খুঁটি 

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১

কোরবানির পশুর বাজার নিয়ে বিবিসি‘র প্রতিবেদন 

রাজিয়া সুলতানা। ঢাকার কাছে সাভারেই একটি খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। খামারে ঈদুল আজহার জন্য পশু লালন পালন করেন। ছয় মাস আগেই টার্গেট নিয়েছেন এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৮টি গরু বিক্রি করবেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সরকার আরোপিত লকডাউন তার মধ্যে গভীর দুশ্চিন্তা তৈরি করেছিল। লকডাউন প্রত্যাহার করে পশুর হাট বাসার অনুমতি দেয়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছে রাজিয়া সুলতানার মনে। রাজিয়া সুলতানা বলেন, খামারে রেখে যে কোরবানির গরু বিক্রি করবো সেটা হয়নি। অনলাইনে একটি গরুও বিক্রি করতে পারিনি। আমরা সারা বছর গরু লালন-পালন করি লাভের জন্য। আমাদের অনেক বিনিয়োগ থাকে। এখন লকডাউন উঠে যাওয়াতে আশা করি আমাদের আশা পূরণ হবে। দেশে করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যু যখন ব্যাপক আকারে বেড়েছে, তখনই সরকার কিছু দিনের জন্য লকডাউন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহার পশু কেনা-বেচা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি খুঁটি।
হাজার-হাজার কোটি টাকার ব্যবসা: প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসেব মতে বাংলাদেশে এবার প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ গবাদি পশু কোরবানির জন্য রয়েছে। গৃহস্থালিতে গরু-ছাগল পালন ছাড়াও প্রায় সাত হাজার খামার রয়েছে যেগুলো ঈদুল আজহার জন্য। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতি বছর কোরবানির পশু গড়ে থেকে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো বেচা-বিক্রি হয়। যদি বিক্রি কম হয়, তাহলে তো অর্থনীতির উপর এটি বিরূপ প্রভাব পড়বেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতে থেকে গরু আসা অনেকটাই কমে গেছে। প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালে কোরবানির পশু নিয়ে ব্যাপক সঙ্কট তৈরি হয়। মূলত তখন থেকেই সরকার এবং খামারিরা উপলব্ধি করেন দেশের ভেতরেই গবাদি পশুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পারভীন মোস্তারী বলেন, ব্রাহমা জাতের গরুর মাধ্যমে গোশত উৎপাদনে পদক্ষেপ এবং গরু মোটাতাজা করণ প্রযুক্তির মাধ্যমে সঙ্কট সামাল দিয়েছে বাংলাদেশ। পারভীন মোস্তারী বলেন, আমরা গরু মোটাতাজাকরণ প্রযুক্তির দিকে নজর দিয়েছিলাম। তিন থেকে চার মাস বয়সী গরুকে বিশেষ কিছু খাবার নিয়ম মতো দিলে গরু দ্রুত মোটা তাজা হয়। এটা বিজ্ঞানসম্মত বিষয়। মানুষ আগে খুব অযতœ-অবহেলায় গরু লালন-পালন করতো। কিন্তু মোটা-তাজা করার প্রযুক্তি যখন ছড়িয়ে গেল তখন অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হলো। তবে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বাড়ছে অবৈধভাবে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন গবেষকরা।
অর্থনীতি অন্যতম খুঁটি: ভারত থেকে গরু আসা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের জন্যই লাভই হয়েছে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কয়েকবছর সময় লাগলেও এটি এখন বাংলাদেশের গ্রামের অর্থনীতির অন্যতম ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম গ্রামীণ অর্থনীতি এবং ঈদুল আজহার পশু বিক্রি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলছেন, গবাদি পশু বিক্রি গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের হাতে নগদ টাকার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। অধ্যাপক ইসমত আরা বলেন, ‘গরু বিক্রি থেকে খামারিরা একটা আয় পায়। সব খরচ বাদ দিয়েও একটি গরুতে অন্তত হাজার দশেক টাকা থাকে। গ্রামের একটি পরিবারের প্রতিদিনের যে প্রয়োজন সেটি অন্যান্য শস্যের মাধ্যমে পূরণ হয়। কোরবানির পশু বিক্রি থেকে তারা একটি থোক টাকা পায়। এর মাধ্যমে তারা সারা বছর নগদ টাকার চাহিদার কিছু অংশ পূরণ করে। গবেষকরা বলছেন, ঈদুল আজহার পশু বিক্রির জন্য যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে সে তত বেশি লাভ পাবে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। আবার ঝুঁকিও রয়েছে। খামারি রাজিয়া সুলতানা বলেন, কোরবানির বাজারে যেসব গরু ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয় সেগুলো চার মাস আগে কেনে খামারিরা। রাজিয়া সুলতানা বলেন, প্রান্তিক খামারিরা চার মাস করে বছরে তিনটা সার্কেল করে। এটা নির্ভার করে আপনি কি ছোট গরু বিক্রি করবেন নাকি বড় গরু বিক্রি করবেন? চামড়া ব্যবসাও জমে ওঠে এ সময় শুধু গবাদি পশু কেনা-বেচা নয়, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে পশুর চামড়া ব্যবসাও অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছেন, বাংলাদেশে সারা বছর যত চামড়া বাজারে আসে তার ৬০ শতাংশই আসে এই ঈদের সময়। এই চামড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৫ শ’ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলছেন, ঈদুল আজহা সময় ভালো মানের পশুর চামড়া পাওয়া যায়। শাহিন আহমেদ বলেন, ঈদুল আজহার সময় যেসব পশু কোরবানি দেয়া হয় সেগুলো খুব যতেœ লালন পালন করা হয়। সেজন্য দেখা যায়, চামড়ার মানও ভালো থাকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গবাদি পশু ঘিরে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম বলছেন, হাটে কেনা-বেচার কাজ পুরুষরা করলেও পশু লালন-পালনের মূল কাজ নারীরাই করে। প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঈদুল আজহার জন্য গড়ে উঠা পশুর খামারগুলো বাংলাদেশের গ্রামের অর্থনীতিতে গতি এনেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়ে অনেকে এখন এসব খামারের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এ খাত বড় ভূমিকা রেখেছে বলে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com