সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন

হালাল ব্যবসাকে হারামে রূপান্তর

ইসলাম ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১

মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য যখন কোনো কিছু হালাল করেছেন, তখন তা ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, আনলিমিটেড। আর যখন কোনো কিছু হারাম করেছেন, তখন একটা একটা নাম ধরে নির্দিষ্ট করে হারাম করেছেন। অর্থাৎ, লিমিটেড। আল্লাহ তায়ালা কোনো একটা হারাম করেছেন, সাথে সাথে এর বিকল্পে অন্য কিছু সেট করেছেন। উদাহরণস্বরূপ- জেনা বা ব্যভিচার করা হারাম; এর বিকল্প বিয়ে হালাল ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা সুদ করেছেন হারাম; এর বিকল্প ব্যবসায় করেছেন হালাল।
যখন আল্লাহ কোনো কিছুকে হালাল সাব্যস্ত করেন; কারো সাধ্য নেই তা হারাম করার। আর যা হারাম করেছেন; কারো সাধ্য নেই তা হালাল করার। অতএব, মানুষ ব্যবসায় করতে গিয়ে যদি তাতে হারামের মিশ্রণ ঘটায় তাহলে ব্যবসা হালাল হলেও তা হারামে রূপ নেয়। আর যে ব্যক্তিই এমনটা করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের ভয়াবহতা।
বর্তমান ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভেজাল সংযুক্তকরণ, প্রতারণা ও মিথ্যা শপথের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসার বিভিন্ন সেক্টর রয়েছে আর প্রতিটি সেক্টরে সাধারণ পদ্ধতিতে কিংবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হারামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাপাক অর্থ উপার্জনে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা খুব বেশি তৎপর।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা থেকে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল থেকে না হারাম।’ (সহিহ বুখারি-২০৫৯) কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার ফলে তাদের ব্যবসায় হালাল থেকে হারামে রূপ নিচ্ছে।
প্রথম বৈশিষ্ট্য : পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সূরা মুতাফফিফিন : ১-৩)
উপরোক্ত আয়াতের শিক্ষা হলো- ‘ওজনে কম না দেয়া’। এই আয়াতে হুঁশিয়ারির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করেছেন যেন আমরা মাপে কম না দেই। যখন ব্যবসায়ীরা নিজেরা পণ্য ক্রয় করেন তখন পূর্ণমাত্রায় তা ওজন করে নেন। কিন্তু অন্যকে বিক্রির সময় ওজন কমিয়ে দেন। এটা চরম প্রতারণা এবং হক নষ্ট।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : কিছু ব্যবসায়ীর মধ্যে অন্য একটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আর তা হলো- জুলুম করা। অর্থাৎ, একটি পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করে সেটা বিক্রি করার সময় তিন-চারগুণ দামে বিক্রি করা। নিশ্চিত একজন ক্রেতার ওপর এটা বড় জুলুম। জুলুমের হাজার প্রকার-পদ্ধতি থাকতে পারে। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জুলুমের শিকার হতে পারে। কিন্তু, জুলুম শুধু জুলুমই হয়ে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না’। (সূরা আনআম-৫৭)
হাদিসে এসেছে, আবুজার গিফারি রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: তাঁর মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি আর তা (জুলুম) তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (সহিহ মুসলিম-৬৭৩৭)
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য : পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে পণ্য বিক্রি করা একটা অন্যতম জঘন্য প্রতারণা। বিশেষত, এই প্রতারণা করার টেকনিক হলো- ১০টা ভালোর মধ্যে এক-দুটি ত্রুটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেয়া যা সাধারণত আলাদা করে বিক্রি করা সম্ভব নয়। এ ধরনের প্রতারণাও নিষিদ্ধ।
হাদিসে এসেছে, নবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সবসময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে।’ (ইবনে মাজাহ-২২৪৭)
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য : মিথ্যা শপথে পণ্য বিক্রি করা। এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লক্ষ করা যায় কাপড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর মাত্রা আরো তীব্রতর রূপ ধারণ করে যখন রমজান মাস উপস্থিত হয়। ঈদের কেনাকাটা অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে, তারা এর সুযোগ ব্যবহার করে বেশি অর্থ আয়ের জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করে থাকে। বলে যে, ভাই, ওয়াল্লাহ! আমার এই জিনিসটার ক্রয়মূল্য এত টাকা, আপনাকে এত টাকা দিতে হবে; না হয় আমাদের লস হবে।
আবুজার রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। তারা কারা, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী।’ (মুসলিম-৩০৬)
পঞ্চম বৈশিষ্ট্য : ধোঁকাবাজির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা। নকল পণ্য বিক্রি করে আসল পণ্যের দর হাতিয়ে নেয়ার মতো ধোঁকাবাজির কোনো অভাব নেই। দেখতে একই ব্র্যান্ডের মোবাইল, একই ধরনের ওষুধ, একই ডিজাইনের কাপড় ইত্যাদি। এ ছাড়াও ভালো পণ্যের সাথে ত্রুটিযুক্ত পণ্য মিশ্রিত করে চালিয়ে দেন।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- একদা রাসূল সা: খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন, ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বলেন, হে স্তূপের মালিক! একি ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে। তিনি বলেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপর রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। যে ধোঁকাবাজি করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ মুসলিম-২৯৫)
ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য : ইহতিকার করা একটা ব্যবসার অন্যতম খারাপ বৈশিষ্ট্য। হাদিস ও ফিকহের ভাষায় মজুদদারিকে ‘ইহতিকার’ বলা হয়। আর মজুদদারকে বা ব্যক্তিকে বলা হয় ‘মুহতাকির’। ফকিহদের বিশ্লেষণ মতে, মজুদদারি হচ্ছে কোনো সঙ্কট বা দুর্ভিক্ষের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা এবং জোগান-চাহিদা ব্যাহত করা। অতঃপর অতিরিক্ত মুনাফায় তা বিক্রি করে দেয়া।
হাদিসে এসেছে, সাহাবি সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘গোনাহগার ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না।’ (সুনানে তিরমিজি-১২৮৫)
সপ্তম বৈশিষ্ট্য : হারাম বস্তু বিক্রি করা কিংবা হারামের প্রসার ঘটিয়ে ব্যবসায় করা। দেশের মধ্যে কত হাজার ধরনের প্রকাশ্য হারাম ব্যবসার ঘাঁটি রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বর্ডিংয়ের নামে দেহ ব্যবসায় যা প্রকাশ্য জেনা, মদের ব্যবসা, ইয়াবার ব্যবসা, জুয়ার ব্যবসা ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেনের নামে অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি। যে জিনিস হারাম তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করাও হারাম।
হাদিসে এসেছে, আবু মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: কুকুরের মূল্য, ব্যভিচারের বিনিময়, গণকের বখশিশ ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি-২১২২, মুসলিম-৪০৯২)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com