খিদমত অর্থ সেবা, কাজ, কর্ম, সার্ভিস ইত্যাদি। খিদমতে দ্বীন অর্থ দ্বীনের সেবা বা দ্বীনের কাজ। দ্বীনের পক্ষে করণীয় সব কাজই খিদমতে দ্বীনের কাজ। ইকামত অর্থ প্রতিষ্ঠা, স্থাপন, উত্তোলন, অবস্থান ইত্যাদি। ইকামতে দ্বীন অর্থ- দ্বীন প্রতিষ্ঠা। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক সব কাজই ইকামতে দ্বীনের কাজ। এখানে দ্বীন দ্বারা ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। সব ঈমানদার দ্বীনের কাজ করেন। কেউ করেন খিদমতের কাজ, আবার কেউ করেন ইকামতের কাজ।
খিদমতে দ্বীন ও ইকামতে দ্বীনের পার্থক্য : খিদমতে দ্বীন ও ইকামতে দ্বীন উভয়ই দ্বীনের জন্য অপরিহার্য কাজ। তবে দ্বীনের প্রাথমিক কাজ হলো খিদমতে দ্বীন। আর চূড়ান্ত কাজ হলো ইকামতে দ্বীন। খিদমতে দ্বীনে কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু ইকামতে দ্বীনে আসে চরম বাধা। যদি নামাজ পড়ার আদেশ দেয়া হয়, রোজা রাখতে বলা হয়, মিসওয়াক করতে বলা হয়, জিকির করতে বলা হয়Ñ এক কথায় আমলে বিল মারুফ (সৎ কাজের আদেশ) করতে বলা হয় তখন কেউ বাধা দেবে না। অনেক মুসলমান মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, মাদরাসা করেছেন, রাস্তা করেছেন, জনহিতকর অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের অনেকে সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, জিনা-ব্যভিচার ইত্যাদি অসংখ্য অপকর্মের সাথেও জড়িত। কেউ কেউ জিহাদ অর্থ করেছেন খেদমত।
কুরআন মজিদেও সূরা তাওবার ৪১ নং আয়াতে বলা হয়েছে তোমরা জিহাদের জন্য বের হও স্বল্প সরঞ্জামের সাথেই হোক বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথেই হোক। এ আয়াতটি তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে অবতীর্ণ হয়। তাবুক যুদ্ধটি হয়েছে গরমের সময় ও ফসল ঘরে তোলার মৌসুমে। তাছাড়া তা ছিল অনেক দূরের পথ এবং শক্তিশালী রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে। রোম সম্রাট মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তার বাহিনীকে আগাম এক বছরের বেতন দিয়েছিল। উপরন্তু আরবের লাঘাম, জুষাম, আমেলা ও গাসসান প্রভৃতি গোত্রগুলোকেও সাহায্যের জন্য একত্র করে। আল্লাহ মুমিনদেরকে এ পরিস্থিতিতে নির্দেশ দিয়েছেনÑ একাকী হও বা দলবদ্ধভাবে, খুশি হয়ে অথবা অখুশি হয়ে, গরিব হও বা ধনী, যুবক হও বা বৃদ্ধ, হেঁটে হোক অথবা বাহনে জিহাদে বের হও।
কিন্তু কেউ কেউ এ আয়াতকে ব্যবহার করছেন- ৩ দিন, ১০ দিন বা ৪০ দিনের জন্য বের হওয়াকে। জিহাদের কোনো আলোচনাই করা হয় না। জিহাদ যেন কোনো বিষয়ই নয়। অথচ সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ ছিল ‘ফুরসানুন নাহার রহুবনুল লাইল’Ñ দিনে সৈনিক রাতে দরবেশ। মহানবী সা:-এর বাণী এক সকাল ও এক সন্ধ্যা আল্লাহর রাস্তায় অতিবাহিত করা, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু থেকে উত্তম (মিশকাত হাদিস নং-৩৮৪৯ মুসনাদ আহমদ)। এ হাদিসে জিহাদে সময় দানকে বোঝানো হয়েছে, অথচ কেউ কেউ অন্যত্র সময় দানকে বুঝেছেন। আপনি যদি মাটির নিচের কার্যক্রমের দাওয়াত দেন আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু যদি সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, ব্যভিচার, পর্দা, অন্যায়, জুলুম-নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন তখন স্বার্থান্বেষী মহল অসন্তুষ্ট হবে, আপনার প্রতি খড়গহস্ত হবে।
খিদমতে দ্বীনের কাজ যদি ইকামতে দ্বীনের সহায়ক না হয়, তবে এ ধরনের খিদমতে দ্বীনের তেমন কোনো মূল্য নেই। লম্বা পাঞ্জাবি, মুখভরা দাড়ি, মাথায় উঁচু টুপি, হাতে তাসবিহ নিয়ে যদি সুদের কারবার করি, অন্যের সম্পদ গ্রাস করি, মাপে কম দেই, ঘুষ নেই, অন্যায় কাজকে সমর্থন করি তাহলে আমার পাঞ্জাবি, দাড়ি, টুপির কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু (সূরা বাকারা-২০৮)। হজরত হুজাইফা বিন ইয়ামিন বলেছেন, এ আয়াতের তাফসির হচ্ছে, ইসলামের ৮টি বিষয় পুরোপুরি আঁকড়ে ধরতে হবে। এর যেকোনো একটি বাদ পড়লে সে পুরোপুরি মুসলমান বলে গণ্য হবে না। সে ৮টি বিষয় হলোÑ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ওমরাহ, জিহাদ, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের বাধা। সর্বপ্রকার অনাচার বন্ধের জন্য যা দরকার তা হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন কায়েম করা।
রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন কায়েম করতে ইকামতে দ্বীনের কাজ খুবই কঠিন। দ্বীনকে পৃথিবীতে কায়েম করার জন্যই নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। খিদমতে দ্বীন বা ইবাদত-বন্দেগির জন্য ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল। মহানবী সা: যে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে বিদায় নিয়েছেন সে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করাই মুমিনের দায়িত্ব। ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে মসজিদ শুধু নামাজ ঘর হিসেবে বিবেচ্য হবে না; বরং মসজিদ হবে শরয়ী সকল বিধিবিধান পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদে চুরির শাস্তি, ব্যভিচারের শাস্তি, মদ পানের শাস্তি ইত্যাদি প্রয়োগ করা হবে। এ মসজিদ থেকেই সুদের, বেপর্দার শাস্তি ইত্যাদির ঘোষণা আসবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে মসজিদ শুধু নামাজ ঘরই থাকবে। তার থেকে অন্য কিছু ঘোষণা আসবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বিষয় বোঝার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক: প্রধান ফকিহ্, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী