আমরা জানি, সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধের আরবের অন্যতম বিজনেস মেগনেট আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা:-এর সব পাওনা সুদের দাবি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বিশ^নবী রাসূলুল্লাহ সা: বাতিল করে দিয়েছিলেন বিদায় হজের ভাষণদানকালে, ৬৩২ সালে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মদিনায় হিজরতের চতুর্থ বছর কুরআনে (মায়িদাহ-৯০) মদ চূড়ান্তরূপে হারাম ঘোষিত হওয়ার পর মদিনার অলিগলিতে মদের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আরবরা তাদের শতবর্ষের গর্ব, অহঙ্কার ও ঐতিহ্যের প্রতীক দামি দামি মদের পাত্র ভেঙে চুরমার করে ফেলেছিলেন। আমাদের কালে কোনো সুদভিত্তিক ব্যাংক যদি সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হতে চায় তাদের পাওনা সুদ, দেনা সুদ ও অন্যান্য সুদভিত্তিক দায়ের কী হবে? এসব প্রশ্নের শরয়ি সমাধান আউফির শরিআহ স্ট্যান্ডার্ড নম্বর ৬-এর আলোকে এ নিবন্ধে আলোচিত হলো।
প্রদত্ত ঋণের কী হবে? রূপান্তরিত ব্যাংককে তার সব প্রকার সুদভিত্তিক ঋণদান পদ্ধতি এখনই বাতিল করতে হবে। নিজ নিজ সংশ্লিষ্ট ইসলামী বিনিয়োগ ধরন দ্বারা প্রত্যেকটি সুদভিত্তিক ঋণদান পদ্ধতি প্রতিস্থাপিত হবে। ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতিসমূহের মধ্যে রয়েছে- মুদারাবা, শরিআহসম্মত সব ধরনের অংশীদারি কারবার, ক্রমহ্রাসমান মুশারাকা, বর্গাচাষের অংশীদারি কারবার (মুজারাআ বা জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের বর্গাচাষ, মুগারাসাহ বা বাগানে গাছ রোপণের ক্ষেত্রে বর্গাচাষ, মুসাকাহ বা ফসলের একটা অংশের বিনিময়ে বিদ্যমান বাগান পরিচর্যা) বাই-মুয়াজ্জাল, মুরাবাহা, সালাম, ইস্তিসনা, অপারেটিং ইজারা, ইজারা মুন্তাহিয়া বিত-তামলিক, এইচপিএসএম (মালিকানায় অংশীদারিত্বভিত্তিক হায়ার পারচেজ) এবং অন্যান্য অর্থায়ন ও বিনিয়োগ পদ্ধতিসমূহ।
রূপান্তরিত ব্যাংককে তার আগেকার সব ঋণ সমন্বয় করে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে, চাই সে ঋণ হোক মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি। এসব ঋণের প্রিন্সিপাল অঙ্ক (মূল ঋণ) তাদের অনুরূপ বিকল্প ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সব ঋণচুক্তি নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলেও কমপক্ষে আদায়কৃত সুদসমূহ নিষ্পত্তি করতে হবে। এসব সুদ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
শরিয়াহ অননুমোদিত বিদ্যমান পাওনার কী হবে? কোনো প্রচলিত ব্যাংককে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা হলে নতুন মালিকরা পূর্ববর্তী সময়ের সুদ ও অন্যান্য শরিয়াহ অননুমোদিত পাওনা ছেড়ে দিতে বাধ্য নন।
যদি ব্যাংকের বিদ্যমান মালিকরা কর্তৃক রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সে ক্ষেত্রে সুদ ও অন্যান্য শরিয়াহ অননুমোদিত পাওনা ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি পরিপালন করতে হবে যেই অর্থ বছরে রূপান্তর কার্যকর হচ্ছে সেই অর্থবছর থেকে। রূপান্তরের আগে যেসব সুদ ও অন্যান্য শরিয়াহ অননুমোদিত আয় বিতরণ করা হয়ে গেছে সে সব আয় ছেড়ে দেয়া বা ত্যাগ করার নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে যারা এগুলো পেয়েছেন সেসব শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের। এখানে ব্যাংকের কিছু করার নেই। হালাল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে এমন আয়, যা এখনো আদায় করা হয়নি, সেগুলো ত্যাগ করা ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, হোক তা রূপান্তরের আগের অথবা রূপান্তর বছরের। একই কথা প্রযোজ্য হালাল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে এমন আয়ের ক্ষেত্রেও, যা ইতোমধ্যে আদায় হয়ে গেছে, এই বিশ্বাসে যে এগুলো হালাল। অর্থাৎ হালাল মনে করে আদায়কৃত সন্দেজনক আয় ত্যাগ করা ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এখানে হালাল মনে করার ভিত্তি হতে হবে নিম্নরূপ-
ক. ব্যক্তিগতভাবে বিচারিক মতামত দেয়ার অবকাশ রয়েছে এমন বিষয়ে ইজতিহাদ করার যোগ্য কোনো ব্যক্তির রায়; খ. কোনো যোগ্য শরিআহ স্কুলের মতামত; অথবা গ. একদল খ্যাতিমান আলেমের মতামত।
শরিয়তে এটা হালাল হওয়ার যুক্তি হলো- কেউ যদি এ বিশ্বাস থেকে কোনো কাজ করে যে, এটা জায়েজ। তখন এ জিনিসটা ততক্ষণ পর্যন্ত তার কাছে জায়েজ আছে যতক্ষণ পর্যন্ত তার ব্যাখ্যাটা ভুল বলে প্রমাণিত না হয়।
ব্যাংক যদি কারো কাছে টাকা-পয়সা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ পাওনা থাকে; আর সেই সম্পদ হয় শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম, এ ধরনের সম্পদ ব্যাংক কেবল নষ্ট করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই গ্রহণ করতে পারবে। কারণ যে জিনিস হারাম শরিয়তের দৃষ্টিতে তার কোনো মূল্যই নেই। এটা ধ্বংস করে দেয়াই শরিয়তের বিধান। যেমন- মদ হারাম ঘোষণা করার পর যাদের ঘরে মদ ছিল তারা সবাই সব মদ ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। অথচ অমুসলিমদের কাছে এ মদের অনেক মূল্য ছিল। মুসলিমরা অমুসলিমদের কাছে হারাম ঘোষিত মদের মওজুদ বিক্রি করে অর্থোপার্জন করতে পারত।
একইভাবে ব্যাংক শরিয়তে অনুমোদন নেই এমন কোনো পণ্য সরবরাহ বা সেবা প্রদানের বিনিময় হিসেবে যদি কারো কাছে টাকা-পয়সা পাওনা থাকে সেগুলো আদায় করবে এবং দান করে দেবে।
রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে রূপান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের হাতে শরিয়াহ অননুমোদিত খাত থেকে কোনো আয় এসে গেলে সে সবের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। উভয় ক্ষেত্রেই গ্রাহককে ব্যাংকের পাওনা ছেড়ে দেয়া যাবে না। কারণ তাতে গ্রাহক এ লেনদেনের জন্য দুটি সুবিধা প্রাপ্ত হবে- এক দিকে ব্যাংক যে পণ্য বা সেবা তাকে সরবরাহ করেছে তা সে লাভ করল; অন্য দিকে এর জন্য তাকে যে মূল্য বা সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করার কথা তা থেকে নিষ্কৃতি পেল।
রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পরও যদি ব্যাংকের হাতে কিছু পুনঃব্যবহার্য সম্পদ থেকে যায়, যা শরিয়াহ অননুমোদিত, সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। যদি এ ধরনের কিছু পণ্য ইতোমধ্যে ব্যাংক বিক্রি করে থাকে এবং এর মূল্য এখনো গৃহীত না হয়ে থাকে; তবে ওই পাওনা তাকে আদায় করতে হবে এবং দান করে দিতে হবে।
যদি ব্যাংকের মালিকানায় এমন কোনো ভূমি বা স্থাপনা থাকে যেগুলো অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হয় (যেমন- ক্লাব, ক্যাসিনো, বার, প্রেক্ষাগৃহ, থিয়েটার ইত্যাদি) সেগুলোকে বৈধ কাজে ব্যবহার করতে হবে বা বৈধ সেবাদানকেন্দ্রে রূপান্তর করতে হবে। কারণ ভূমি বা স্থাপনা নিজে হারাম নয়। হারাম হলো তার ব্যবহার। সুতরাং হারাম কাজে ব্যবহার বন্ধ করে এসব ভূমি বা স্থাপনা হালাল কাজে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তীতে আলোচিত হবে, ‘ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তর-পূর্ব দায়-দেনা : অভ্যন্তরীণ রূপান্তর ও বহিঃরূপান্তর : শরিয়তের বিধান।’ লেখক: সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং