গত জুলাইয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে পাঁচ শিশু। এরমধ্যে ছয় বছর দুই মাসের এক শিশু করোনায়ও আক্রান্ত ছিল। খিলগাঁওয়ের এই শিশুটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরে করোনা ধরা পড়ে। এ মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এ বছরে এখন পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে চলতি মাসের ১৯ জন ছাড়া গত জুলাইয়ে ১২ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়। শুক্রবার (২০ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এ তথ্য জানায়।
গত ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম ডেঙ্গুতে মৃত্যু আশঙ্কাজনক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি তাতে অন্য যেকোনও সময়ের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি নয়, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।’ সেদিন পর্যন্ত মোট ২৬ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি রোগীর সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে এই ৬ হাজার ৬৫০ জন রোগীর বিপরীতে ২৬ মৃত্যু, এটি অত্যন্ত শঙ্কার বিষয়।’ ১৮ আগস্ট তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত আগস্ট মাসে ৩ হাজার ৯৯২ জন রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ রোগী পেয়েছিলাম। কাজেই জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এটি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যাতে না যায় সে জন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে হবে।’
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমে আসছে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের তা-ব কমছে প্রায় তিন মাস পর। কিন্তু নতুন করে এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে ডেঙ্গু নিয়ে। করোনার ভেতরেই ডেঙ্গুর মারাত্মক রূপ নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। তবে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। স্বাস্থ্য অধিদফতর শুক্রবার (২০ আগস্ট) জানায়, দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এক হাজার ১৯০ জন। এরমধ্যে ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি ৪১টি হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ৯৪ জন এবং অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এক হাজার ৪০৫ জন, আর কেবল এ মাসের ২০ দিনেই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৮১৪ জন। এ ছাড়া ১৯ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে ২০ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২১ জন। এরমধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১২ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৯ জন। অথচ এ বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে তিন জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন এবং জুলাইয়ে শনাক্ত হয়েছিলেন দুই হাজার ২৮৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ইতোমধ্যে সরকার ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল চালু করার ঘোষণা দিয়েছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, যেখানে করোনা রোগীর চিকিৎসা হয়, সেখানে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এবারের ডেঙ্গুতে শিশুদের পাশাপাশি তরুণরা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। ১৪ থেকে ২০ বা ২৫ বছর বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ব্যক্তিগত চেম্বারেও একই অভিজ্ঞতা তাদের।
জ্বর হলে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষার অনুরোধ: যেহেতু করোনা এবং ডেঙ্গু দুটোর লক্ষণ, উপসর্গই হচ্ছে জ্বর। তাই জ্বর হলে কেবল করোনা নয়, ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে বলেও অনুরোধ করছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকায় ডেঙ্গু বেড়ে চলেছে, করোনার এই সময়ে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কেউ বুঝতে পারছে না। নীরবেই বাড়ছে। এখনই নজর দেওয়া না হলে পরিস্থিতির অবনতি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘কারও জ্বর হলে এখন করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষাও করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সারাদেশে সিভিল সার্জনদের কাছে পর্যাপ্ত এনএস-১ কিট সরবরাহ করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পরীক্ষা করানো সম্ভব হবে।’
দ্রুত খারাপ হচ্ছে রোগী: তিন থেকে চার দিনের জ্বরে এক ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে বেসরকারি গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান কনক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুটির পরিবার স্বাভাবিক ভাইরাস জ্বর হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু শিশুটি যখন অজ্ঞান হয়ে যায়, তারপর হাসপাতালে আনার এক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।’ নিজের রোগী দেখার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগীরা এখন একেবারে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় এসে ভর্তি হচ্ছেন, তার আগে আসছেন না।’ ‘অনেক রোগীই পাচ্ছি ভর্তি হচ্ছেন যখন তার ১২ থেকে ১৩ হাজার প্লাটিলেট। ১২ থেকে ১৩ হাজার প্লাটিলেট কাউন্ট সমস্যা নয়, কিন্তু ১২ থেকে ১৩ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে আসা মানে তিনি আরও আগে থেকেই আক্রান্ত। কিন্তু তারা সেটা জানতো না বা জানলেও সঠিক গাইডেন্স পাচ্ছিল না’, বলেন তিনি।
এখন ডেঙ্গুর মৌসুম, আর জ্বর হওয়ার পরে সিবিসি (রক্তের পরীক্ষা) আর এনএসওয়ান (ডেঙ্গু পরীক্ষা) করা দরকার, এটাই কেউ বুঝতে পারছে না জানিয়ে ডা. রাশেদুল হাসান কনক বলেন, ‘সবাই এখনও করোনা লুকানোর চেষ্টা করছে সেই আগের মতোই।’ তিনি বলেন, ‘এই ১৬ মাসেও করোনা নিয়ে ভীতি বা সেই প্রথম সময়ের মতো করোনা রোগীর “অচ্ছুৎ” অবস্থা এখনও যায়নি। আর এ জন্য জ্বর হলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না। আর এই আমলে না দিতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ করছে। এতে রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। যখন হাসপাতালে আসছে তখন আর কিছু করার থাকছে না।’ ডা. রাশেদুল হাসান কনক বলেন, ‘করোনা তবু তরুণদের কিছুটা সময় দিচ্ছে, কিন্তু ডেঙ্গু সময় দিচ্ছে না।’
টেলিমেডিসিন কিছুটা সমস্যা: করোনাকালে মানুষের বন্ধু হয়ে পাশে থেকেছে টেলিমেডিসিন সেবা। কিন্তু করোনা এবং ডেঙ্গুর এই সময়ে ফোনে ফোনে সেবা কিছুটা সমস্যা করছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
‘টেলিমেডিসিন বিপদে পড়ে নেওয়া, কিছুটা সমস্যাতো হবেই’- এমন মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগী না দেখে, কেবল কথা শুনে সব চিকিৎসা হয় না। কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এটা বাস্তবসম্মত। মেনে নিতেই হবে।’
ডা. রাশেদুল হাসান কনক বলেন, ‘এই সময়ে ফোনে ফোনে সেবা সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখনও কেউ চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছে না। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে হাই স্ট্যাটাস।’ যাদের চিকিৎসকদের সঙ্গে কানেকশন বেশি, তারাই সবচেয়ে বেশি সাফার করছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আর এ থেকে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে আমি মনে করি। আর সেই সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য জটিলতা।’
প্রকোপ চলবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত: ডেঙ্গু বেড়েই যাচ্ছে আর লকডাউনের ভেতরেই এটা বেড়েছে মন্তব্য করে অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘লকডাউনের ভেতরে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গিয়েছে, আর এই সুযোগে মশা আরামে বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘কেবল বাড়িঘর নয়, অফিস, দোকানপাট সবই বন্ধ ছিল। এ কারণে বংশ বৃদ্ধি করায় ডেঙ্গু বেড়েছে। তাই সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। তবে আগামী সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর নাগাদ এটা বাড়তেই থাকবে। এরপর শীত এলে হয়তো কমবে।’
দেশে যে এবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে সে বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘গত জুন মাসেই এ বিষয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম। আর বর্তমান যে অবস্থা সেটা চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। যদি সেটা থাকে তাহলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখনকার চেয়ে বাড়বে না।’