কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করতে না পারা ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে বড় আকারে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। আন্তর্জাতিক পরিম-লে ব্যাংকটির ভাবমূর্তি সংকটে পড়ায় বিদেশী অনেক ব্যাংকই ঋণপত্র (এলসি) গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। আবার এলসি গ্রহণ করলেও সেজন্য দিতে হচ্ছে কনফারমেশন ফি। এতে দেশের আমদানি ব্যয় বাড়ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এজন্য মূলধন ঘাটতি পূরণে আবারো ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছে চেয়েছে এ ব্যাংকটি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেট থেকে নগদ অর্থ না নিয়ে নগদ সহায়তার বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু বা সরকারি গ্যারান্টিপত্র অথবা নামমাত্র সুদে পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
সোনালী ব্যাংক বলছে, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাস্তবায়নের বিপরীতে কোনো বাণিজ্যিক মূল্য না পাওয়ায় মুনাফা কমছে। পাশাপাশি ক্রমেই বাড়ছে মূলধন ঘাটতি। এজন্য মুনাফা বাড়াতে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সেগুলোর বাণিজ্যিক মূল্য চেয়েছে ব্যাংকটি। এর আগেও গত বছর এ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে নগদ অর্থের পরিবর্তে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে ১০ হাজার কোটি টাকার সরকারি গ্যারান্টি-পত্র ইস্যু করার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। সে সময় এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, এক্ষেত্রে গ্যারান্টি-পত্র ইস্যু করে মূলধন ঘাটতি পূরণের সুযোগ নেই। তাছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকও একই ধরনের সুবিধা পেতে আবেদন করতে পারে এমন বিবেচনায় সোনালী ব্যাংকের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সঠিক হবে না জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সে সময় সোনালী ব্যাংকের প্রস্তাব নাকচ করে। এবার সোনালী ব্যাংক তাদের মূলধন ঘাটতি পূরণে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ সহায়তার বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি পূরণ। কিংবা সরকারি গ্যারান্টি-পত্র ইস্যু করা এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মূলধনহিসেবে স্বীকৃতিদানের বিষয়েটি পুনর্বিবেচনা করা অথবা মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ সুদহারে পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যু করে মূলধন ঘাটতি পূরণ। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছেন। এরপর প্রয়োজন হলে আবারো বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নেয়া হবে, তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এদিকে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হলেও ব্যাসেল-৩-এর কঠোর নিয়মানুবর্তিতার কারণে বিভিন্ন সমন্বয় ও শ্রেণীকৃত ঋণাধিক্য এবং প্রভিশন ঘাটতিজনিত কারণে নিট মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত এবং একমাত্র ট্রেজারি ব্যাংক হিসেবে এ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি বড় এলসিগুলো খোলা হয়ে থাকে। যেমন সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যে একটি এলসি এ ব্যাংক থেকে খোলা হয়েছে। তাছাড়া বিপিসি, খাদ্য, সমরাস্ত্র, রেলওয়ে এসব প্রতিষ্ঠানেরও এলসি খোলা হয়। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকলে অনেক বিদেশী ব্যাংক এ ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে চায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করলেও কনফারমেশন ফি দাবি করে। এতে সরকারের এবং দেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়ে যায়। এ কারণে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ অত্যাবশ্যক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলধন ঘাটতি পূরণে যেসব প্রস্তাব দিয়েছি, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আশা করছি শিগগির সরকার এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসবে। বিদেশী ব্যাংকগুলো সোনালী ব্যাংকের এলসি নিতে চাচ্ছে না এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা শুধু সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রেই নয়, যখন একটা ব্যাংকের ব্যালান্স শিট খারাপ হয়, তখন এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাইরের ব্যাংকগুলো যে ঝুঁকি গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে প্রিমিয়ামটা বেশি ধরে।
এক্ষেত্রে প্রিমিয়াম বেশি চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা দুর্বল ব্যাংক যখন কোনো সুবিধা চায়, তখন তার দুর্বলতা দেখে অন্য ব্যাংকগুলো ঝুঁকি মূল্যায়ন বেশি করে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে যে কমিশন হয়তো ৩০ টাকা হওয়ার কথা কিন্তু সেটা হয়তো ৫০ টাকা করে বসল। এটা স্থানীয় ব্যাংকগুলো করে থাকে। সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে তার মানে আমাদের ব্যালান্স শিটটা খারাপ, তখন তার ওপর বিভিন্ন ঝুঁকি মূল্যায়ন করে বাইরের ব্যাংকগুলো। মূলধন ঘাটতির প্রস্তাবের পাশাপাশি ব্যাংকের আয় বাড়ানোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে প্রদত্ত সেবার বিপরীতে যৌক্তিক হারে সেবার মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংক কর্তৃক সরকারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুকূলে ইস্যুকৃত ৯৪ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার ঋণপত্রের ক্ষেত্রে কমিশন বাবদ থোক বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাবের পরিবর্তে পরিমিত (স্ট্যান্ডার্ড) হারে কমিশন দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিও জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এটা সরকারি ব্যাংক। যেভাবেই হোক মূলধন ঘাটতি হয়ে গেছে, এখন চাইলে সরকার টাকা দিতে পারে। তবে এটা অনেক বড় ব্যাংক। এখানে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে মূলধনের জন্য টাকা দেয়ার প্রয়োজন নেই। জনগণ জানে এটা সরকারি ব্যাংক, তাই তাদের (সোনালী ব্যাংক) আমানতের কোনো অভাব হবে না। বরং তারা খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে পারে, একই সঙ্গে নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিতে হবে, যাতে নতুন করে আর খেলাপি ঋণ না বাড়ে। তাহলেই ব্যাংকটির অবস্থা ভালো হয়ে যাবে।