সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৭ পূর্বাহ্ন

বিবিসির রিপোর্ট: যেমন আছেন ভারতের মুসলিমরা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

কোনো প্ররোচনা ছাড়াই ভারতে মুসলিমদের ওপর হামলা চালায় হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকজন। এ বিষয়টি এখন নিয়মিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকারের তরফ থেকে কোনো নিন্দা জানানো হয় না বললেই চলে। অনলাইন বিবিসিতে গীতা পান্ডের লেখা এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে তিনি আরো লিখেছেন, গত মাসে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, হিন্দু স¤প্রদায়ের একদল মানুষ একজন মুসলিম পিতাকে নির্যাতন করছে। এ সময় ভয়ে তার ছোট্ট মেয়েটি তাকে আর প্রহার না করার আকুতি জানাচ্ছে। হতাশাজনক এই ফুটেজে দেখা যায়, উত্তর প্রদেশের কানপুর শহরের রাস্তায় ৪৫ বছর বয়সী একজন রিক্সাচালককে প্যারেড করানো হচ্ছে।
এ সময় তাকে প্রহার বন্ধ করতে চিৎকার করে কান্না করছে তার ছোট্ট মেয়েটি। হামলাকারীরা ওই মুসলিম রিক্সাচালককে ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ অথবা ভারত দীর্ঘজীবী হোক, জয় শ্রীরাম বা প্রভু রামের জয়- এসব স্লোগান দিতে বলে। ওই ব্যক্তি এসব স্লোগান দেয়া সত্ত্বেও তাকে প্রহার করতেই থাকে তারা। আক্রমণের শিকার ওই মুসলিম এবং তার মেয়েকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ হামলার জন্য গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। তবে পরের দিনই তাদেরকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এর কয়েক দিন পরে আরো একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, চুড়ি বিক্রেতা একজন মুসলিম তসলিম আলিকে থাপড়, লাথি ও ঘুষি মারছে হিন্দু স¤প্রদায়ের কিছু লোক। এ ঘটনা ঘটে মধ্য প্রদেশের ইন্দোরে। প্রহার করতে করতে তাকে ভবিষ্যতে হিন্দুদের এলাকা থেকে দূরে থাকার সতর্কবার্তা দেয়। পরে পুলিশের কাছে দেয়া অভিযোগে তিনি বলেন, তাকে ৫ থেকে ৬ জন ব্যক্তি প্রহার করেছে। এ সময় হিন্দুপ্রধান এলাকায় চুড়ি বিক্রির জন্য সা¤প্রদায়িক আঘাত দিয়ে কথা বলেছে। তার অর্থ, মোবাইল ফোন ও কিছু ডকুমেন্ট তারা ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। পরেরদিনই হামলাকারীদের ১৩ বছর বয়সী একটি কন্যাকে তসলিম আলি যৌন নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অভিযোগ তার পরিবার ও প্রতিবেশীরা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তসলিম ৫ সন্তানের পিতা। তিনি এ কাজ করতে পারেন, এটা তারা মোটেও বিশ্বাস করেন না। ভারতীয় প্রেসে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, তসলিমকে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে প্রহার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে কন্যার ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সাজানো হয়েছে। আগস্টে মুসলিম বিরোধী সহিংসতার কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত এই হামলার দু’জন। একই রকম অনেক হামলার রিপোর্ট পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে এবং সেগুলো সংবাদ শিরোনাম হয়। মার্চে ১৪ বছর বয়সী একটি মুসলিম বালক হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশ করেছিল পানি পানের জন্য। এ অপরাধে তাকে ভয়াবহভাবে প্রহার করা হয়েছে। জুনে হিন্দু প্রধান এলাকায় ফল বিক্রি করতে যাওয়ার অপরাধে একজন ফেরিওয়ালে দিল্লিতে প্রহার করা হয়েছে।
গত তিন বছর ধরে ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলাকে ডকুমেন্ট আকারে ধারণ করছেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক আলিশান জাফ্রি। তিনি বলেন, ব্যাপক সহিংসতা হচ্ছে। এর ব্যাপকতা যেন সাধারণ বিষয়। মেনেও নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন তিনি এমন তিন থেকে চারটি ভিডিও ধারণ করেন। এর মধ্যে একটি বা দুটি যাচাই করে তবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে পারেন।
সমালোচকরা বলেন, ধর্মীয় বিরোধ ভারতে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। ২০১৪ সালের পর মুসলিম বিরোধী সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দিল্লি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক প্রফেসর তানভীর ইজাজ বলেন, সা¤প্রদায়িক সহিংসতা সা¤প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। তবে ক্ষমতাসীনদের কারণে তা বেড়েছে এবং রাজনৈতিক মোবিলাইজেশনের জন্য তা বেড়েছে। সব সময়ই অবিশ্বাস ছিল। কিন্তু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত জাতীয়তাবাদের দ্বারা এখন এর কিছু অংশের প্রকাশ ঘটেছে।
গীতা পান্ডে আরো লিখেছেন, মোদির প্রথম মেয়াদে ক্ষমতার সময়ে মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। বিশেষ করে কথিত ‘কাউ ভিজিল্যান্টিস’ ইস্যুতে এই হামলা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেউ গরুর মাংস খেয়েছেন অথবা কেউ গরু পাচারের চেষ্টা করেছেন অথবা গরু জবাই করেছেন- এমন অভিযোগে হামলা হয়েছে। ওইসব হামলার কোনো নিন্দা জানাননি প্রধানমন্ত্রী। দ্রুততার সঙ্গে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে এর নিন্দা না জানানোর সমালোচনা হয়েছে। বিজেপির সিনিয়র নেতা প্রকাশ জাভেদকর বিবিসিকে বলেছেন, সরকার বিশ্বাস করে কাউকে এভাবে প্রহার করা খারাপ। তবে রাজ্যে আইন শৃংখলা একটি বিষয়। এটা তাদের মেনে চলা উচিত। এ পর্যায়ে তিনি মুসলিমদের ওপর হামলার বিষয়ে মিডিয়াকে দায়ী করেন পক্ষপাতী এবং সেলেক্টিভ জার্নালিজমের জন্য। তিনি বলেন, সরকারি হিসাবে ২০০ মানুষের ওপর হামলা হয়েছে। তার মধ্যে ১৬০ জনই হিন্দু। সব ধর্মের লোককেই টার্গেট করা হয়েছে। তবে এসব ডাটা কোথায় পাওয়া যাবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছুই বলতে পারেননি। কারণ, ভারতে এসব ডাটা সংগ্রহ করা হয় না।
২০১৯ সালে একটি ফ্যাক্ট-চেকার ওয়েবসাইট হিসাবে কষে দেখেছে যে, ভারতে যে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ হয় তার মধ্যে গত ১০ বছরে যারা এর শিকার, তার শতকরা ৯০ ভাগের বেশি হলেন মুসলিম। অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও হামলাকারীদের কোনো শাস্তি হয়নি। কারণ, তারা মোদির বিজেপির রাজনৈতিক ছায়া উপভোগ করে। পক্ষান্তরে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যার জন্য অভিযুক্ত হিন্দু স¤প্রদায়ের আটজনকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছেন সরকারের একজন মন্ত্রী। বিরোধী কংগ্রেস দলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমন্বয়ক হাসিবা আমিন বলেন, এমন হামলা বর্তমানে ভারতে অনেকটা সাধারণ হয়ে উঠেছ। এর একমাত্র কারণ, অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পায়। এখন তো মূলধারায়ই ঘৃণা। এর ফলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলাকে প্রলুব্ধ করে। হামলার জন্য ঘৃণাপোষণকারী ব্যক্তিদের পুরষ্কৃত করা হয়।
সমালোচকরা বলেন, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন মোদি। সমালোচকরা বলেন, তখন থেকে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা বিস্তৃত হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। অনেক সময় এই সহিংসতা শারীরিকভাবে করা হয় না। গত বছর ভারতে করোনা দেখা দেয়। এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মুসলিমদের দায়ী করেন মোদি সরকারের মন্ত্রীরা, দলীয় সহকর্মীরা এবং হিন্দু নেতারা। এরপর আসে ‘রুটি জিহাদ’। অভিযোগ তোলা হয়, মুসলিমরা হাতে যে রুটি প্রস্তুত করেন তার মাধ্যমে হিন্দুদের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া হয়।
স¤প্রতি কিছু রাজ্যে ‘লাভ জিহাদ’কে খর্ব করতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনকে ব্যবহার করে হিন্দু ধর্মের কোনো যুবতীর সঙ্গে মুসলিম যুবকের প্রেম হলে বা বিয়ে হলে ওই মুসলিমকে হয়রানি করা হয় অথবা জেলে পাঠানো হয়। মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়ের পর একজন অন্তঃসত্ত্বা হিন্দু যুবতীকে জোর করে তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়। এক পর্যায়ে ওই যুবতীর গর্ভপাত হয়েছে। এ বিষয়টি সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। মুসলিম নারীদেরও ছেড়ে দেয়া হয় না। জুলাইয়ে তাদের কয়েক ডজন দেখতে পান, অনলাইনে তাদেরকে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। মে মাসে কংগ্রেস পার্টির মিস আমিন সহ তাদের অনেককে ‘নিলামে’ বিক্রির জন্য তোলা হয় অনলাইনে।
গত মাসে বিজেপির সাবেক একজন নেতা দিল্লিতে র‌্যালি আয়োজন করেন। তাতে অংশগ্রহণকারীরা মুসলিমদের হত্যা করতে হবে বলে স্লোগান দেয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com