‘তিনি (আল্লাহ) দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তিদান (যৌবন) করেন। অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য’ (সূরা রুম-৫৪)।
তারুণ্য অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এমন একটি অধ্যায় যখন শক্তি, সামর্থ্য সব কিছুই সর্বোচ্চ স্তরে থাকে। মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান সময় হচ্ছে যৌবনকাল। এ সময় যেমন সব বাধা সহজেই মোকাবেলা করা যায় তেমনি দিকভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। তাই এই তরুণদের প্রতি রাসূল সা: বিশেষভাবে যতœশীল ছিলেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তাদেরকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যা আজও আমাদের তরুণদের জন্য চলার পথে আলোকবর্তিকাসম।
তাঁর চার পাশের কিশোর ও তরুণরা তাই হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য ঝঞ্ছা, যারা প্রবল শক্তিমত্তার সাথে মোকাবেলা করেছিল কাফির-মুশরিকদের রক্তচক্ষুসহ নানা অন্যায়-অবিচার। তারা ছিল এমন বীরসেনানী, যারা বদর, ওহুদ, খায়বারসহ বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়েছিল। সেই তরুণ যুবকদের প্রজন্ম রাসূলের আদর্শে এমনভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল যে, রাসূলুল্লাহ সা:-এর অবর্তমানেও তারা ইসলামকে পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল প্রবল বীরত্বের সাথে। আমরা সেই বীরসেনানীদেরই উত্তরসূরি কিন্তু দিশাহীন ও মৃতপ্রায় এক তরুণ প্রজন্ম। আবার জেগে উঠতে আমাদের চাই রাসূল সা:-এর দিকনির্দেশনার সঠিক বাস্তবায়ন।
রাসূলুল্লাহ সা: তরুণদের ঈমান, আমল ও আখলাক নিয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি যুবকদের কার্যক্ষমতা ও আত্মউন্নয়নের পাশাপাশি আকিদায় শক্তিশালী হতে উৎসাহিত করেছেন। মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:কে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে মুয়াজ, তুমি কি জানো বান্দার ওপর আল্লাহর অধিকার কী এবং আল্লাহর ওপর বান্দার হক কী? তারপর তিনি বললেন, ‘বান্দার ওপর আল্লাহর অধিকার হচ্ছে, সে আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না, তার সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর বান্দার হক হলো যদি তারা নিজেদের শিরক করা থেকে হিফাজত করে তাহলে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নাম থেকে নিরাপদ রাখবেন’ (বুখারি-৬৫০০)।
রাসূল সা: যুবকদের বেশি বেশি আমল ও ইবাদত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন, ‘তরুণ বয়সের ইবাদতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। একজন বৃদ্ধের ইবাদতের চেয়ে আল্লাহ বেশি খুশি হন, সে তরুণ ও যুবকদের ইবাদতে যারা যৌবন বয়সে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে’ (আবু দাউদ)।
তরুণদের নিজেদের সৎ ও চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে রাসূল সা: জোর তাগিদ দিয়েছেন। তারাই প্রকৃত সফলকাম, যারা বয়ঃসন্ধিক্ষণে যৌবনের উন্মাদনা থেকে নিজেদের সম্ভ্রমকে বাঁচিয়ে রাখবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাদেরকে এই দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি নিয়ামত দিয়ে সম্মানিত করার ওয়াদা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা করেছেন, ‘আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে তার আরশের ছায়ার নিচে স্থান দেবেন। যে দিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে ওই যুবক, যাকে কোনো সুন্দরী সম্ভ্রান্ত নারী আহ্বান করে। কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি’ (বুখারি-১৪২৩)।
সম্ভ্রম হিফাজতের জন্য রাসূল সা: যুবকদের দৃষ্টি হিফাজত করার নির্দেশ দিয়েছেন ও দ্রুত বিয়ের তাগিদ দিয়েছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের বিয়ে করা উচিত। কেননা, এটা দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সুরক্ষিত রাখে। আর তোমাদের যে লোকের বিয়ের সামর্থ্য নেই সে যেন রোজা রাখে’ (ইবনে মাজাহ-১৮৪৫)।
যৌবনকাল একজন মানুষের জীবনের স্বর্ণযুগ। কারণ কর্মসম্পাদন, ক্যারিয়ার গঠন ও নেক আমল করার মুখ্য সময় এই যৌবনকাল। রাসূল সা: তাই যুবকদের তারুণ্যের সর্বোৎকৃষ্ট সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে আদেশ করেছেন- ‘… তোমরা যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার আগেই’ (বুখারি ও মুসলিম)।
তাই তরুণদের উচিত নিয়ামত থাকা অবস্থাতেই এর সঠিক ব্যবহার করা এবং নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। এ ছাড়া রাসূল সা: হুঁশিয়ার করেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া কোনো আদম সন্তান আল্লাহর সামনে থেকে পা সরাতে পারবে না। … তার জীবনকে কোথায় ব্যয় করেছে। তার যৌবনকে কোথায় ক্ষয় করেছে’ (তিরমিজি-২৪১৬)।
রাসূল সা: তরুণদের আরো বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছেন যা তাদের পথচলার অন্যতম পাথেয়-
১. পৃথিবীতে আল্লাহর পর সবচেয়ে বেশি সম্মানিত আমাদের মা-বাবা। মা-বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাদের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। তারাই আমাদের জান্নাত এবং জাহান্নাম। রাসূল সা: বলেন, ‘তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যে বৃদ্ধ অবস্থায় তার মা-বাবা দু’জনকে পেল অথবা তাদের একজনকে। কিন্তু (তাদের খেদমত করে) নিজের জন্য জান্নাতের পথ সুগম করতে পারল না’ (মুসলিম-২৫৫১)। তাই তরুণদের অবশ্যই শত কাজের মাঝেও মা-বাবার খেদমতে যতœশীল হতে হবে।
২. সালাতের ব্যাপারে যতœশীল হওয়া এবং সময়মতো সালাত আদায় করা। কেননা, সালাত মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। বিচার দিনে সবার আগে সালাতের হিসাব নেয়া হবে।
৩. ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া খেল-তামাশার তুচ্ছ ফাঁদ। রাসূল সা: এর থেকে তরুণদের সতর্ক থাকতে বলেছেন এবং সব কিছুর থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তোষকে প্রাধান্য দিতে আদেশ করেছেন। হারাম থেকে বেঁচে থাকা, তা যতই চিত্তাকর্ষক হোক না কেন। অপর দিকে, হালাল উপার্জন বারাকায় পরিপূর্ণ যদিও তা পরিমাণে কম।
৪. প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করা যাতে করে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগেই নিজের ভুলগুলো শুধরানোর সুযোগ পাওয়া যায়।
৫. কাউকে উপদেশ দেয়ার আগে নিজে সেটা করে দেখানো। যে মানুষ অন্যকে উপদেশ দেয় কিন্তু নিজে সেটা পালন করে না তার শাস্তি ভয়ানক।
৬. কোনো খারাপ কাজকেই ছোট করে না দেখা। কেননা, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তায়ালা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব কাজেরই হিসাব নেবেন।
৭. কোনো কাজে দীর্ঘসূত্রতা না করা। কারণ আগামীকাল সর্ম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তাই বর্তমান মুহূর্তকে শেষ সময় মনে করে পুরোপুরি কাজে লাগানো।
৮. গিবত থেকে দূরে থাকা। কেননা, যার গিবত করা হয়েছে সে ক্ষমা না করলে, আল্লাহ তায়ালাও ক্ষমা করবেন না।
৯. আল্লাহর কাছেই সবকিছু চাওয়া, যদি সেটা জুতার ফিতার মতো তুচ্ছ জিনিসও হয়। কেননা, একমাত্র আল্লাহই দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
১০. সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণ করা, ভুলে না যাওয়া। তাহলে খারাপ সময়েও আল্লাহকে কাছে পাওয়া যাবে। আর সব অবস্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা এবং তকদিরে বিশ্বাস করা।
১১. বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুকরণ করা থেকে বিরত থাকা। যার জন্য মুসলিম যুবসমাজ আজ ধ্বংসের পথে। রাসূল সা: হুঁশিয়ার করেন, ‘সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয় যে ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে অন্য কারো সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইহুদিদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না আর খ্রিষ্টানদেরও না’ (তিরমিজি-২৬৯০)।
১২. তরুণদের মদ, জুয়াসহ সবরকম নেশাজাতীয় দ্রব্য ও গান, বাদ্য-বাজনার মতো হারাম থেকে দূরে থাকতে রাসূল সা: আদেশ করেছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতের জন্য মদ, জুয়া, ঢোল, তবলা ও বীণা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করেছেন’ (আহমাদ-১৭০৮)। কেননা এখনকার যুবকদের চরিত্র হননের অন্যতম হাতিয়ার এসব নিষিদ্ধ জিনিস। যার ছোবল থেকে আমাদের মুসলিম যুবকরাও আজ নিরাপদ নেই।
আমাদের মুসলিম তরুণরা আজ দিশেহারা। কারণ তাদের নেই পূর্বসূরিদের মতো হৃদয় যা আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থায় পরিপূর্ণ, রাসূলের সুন্নাহ অনুসরণে স্পর্শকাতর এবং নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যুবকদের দৈহিক শক্তি উদ্ভাবনী মেধা ও চিন্তা-ফিকির করার যোগ্যতা অনেক বেশি দিয়েছেন। দৃঢ় মনোবল, ধৈর্য, তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ও তাকদিরে বিশ্বাসের যথাযথ সমন্বয়ের পাশাপাশি রাসূল সা:-এর নির্দেশনা অনুযায়ী এই সুবর্ণ সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলেই আমাদের মুসলিম যুবকরা সঠিক পথের দিশা পাবে।