দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে নিরাপদ ও আরামদায়ক যাতায়াতে ট্রেনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ফলে গত এক দশক ধরে এই খাতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে বিনিয়োগ। এখন রেলওয়েতে চলমান ৪১টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে পদ্মা সেতু রেল ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্মোচন হবে নতুন দিগন্ত। কক্সবাজার-বান্দরবানসহ পর্যটন এলাকাগুলোতে রেল সংযোগে জোর দিচ্ছে সরকার। পদ্মা সেতু, কক্সবাজারের রেল সংযোগ চালু হলে আরও অনেকগুলো জেলার মানুষ এর সুবিধা ভোগ করবে। লাইন টেনে যুক্ত করাও হবে সুবিধাজনক। ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে এমনিতে জনপ্রিয় রেল। নতুন কোচ, ইঞ্জিন যুক্ত হওয়ায় সেটা আরও বেড়েছে। এছাড়া টাইমের ক্ষেত্রে আগের জটিলতা এখন কম। অধিকাংশ ট্রেন চলে অনটাইমে। সমস্যা শুধু কিছু ট্রেনে সেবার মান ও পাথর নিক্ষেপ। তবু জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রেলপথ। গত ১৪ অক্টোবর ট্রেনে চট্টগ্রামে বেড়াতে যান ধানমন্ডির জিগাতলার আমিন উদ্দিন দম্পতি। ১৯ অক্টোবর সকালে তারা ঢাকার কমলাপুরে ফেরেন। ওইদিন সকালে আলাপকালে আমিন উদ্দিন বলেন, বাসে যাতায়াতের চেয়ে ট্রেনে ভ্রমণ অনেকটাই নিরাপদ। দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করলেও ক্লান্ত লাগে না। বাসের তুলনায় ট্রেনে ভাড়াও কম। তাই যেসব পর্যটন এলাকায় রেল সংযোগ রয়েছে, সেখানে ট্রেনেই যাতায়াত করি। একই দিন সকাল সাড়ে ৭টার ট্রেনে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ব্যবসার কাজে প্রায়ই ঢাকায় যাতায়াত করতে হয়। এই যাতায়াতে ট্রেনই প্রথম পছন্দ। বাসে শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। ট্রেনে তা হয় না। তবে ট্রেনের সেবার মান আরও বাড়ানো দরকার।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, এখন দেশের ৪৪টি জেলায় রেল সংযোগ রয়েছে। এই ৪৪টি জেলায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে প্রায় সাত কোটি যাত্রী পরিবহন করেছে রেলওয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলে যাতায়াত করেছেন নয় কোটি ২৭ লাখ। পরের বছর ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রায় নয় কোটি ৩০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেছে রেলে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে সাড়ে নয় কোটির বেশি মানুষ রেলে ভ্রমণ করেছেন। এভাবে প্রতি বছরই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেলে যাত্রীর সংখ্যা। এর সঙ্গে রেলের সক্ষমতাও আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়েছে। রেলওয়েতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন কোচ ও ইঞ্জিন। কমলাপুর রেলওয়ে সূত্র জানায়, এখন কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে দিনে ১১৪ জোড়া ট্রেন (আন্তঃনগর ও মেইল) যাত্রী পরিবহন করে। এসব ট্রেনে হাজারো লোক যাতায়াত করেন। এখন যাত্রীদের যাতায়াত সুবিধার্থে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই নির্দিষ্ট গন্তব্যে ভ্রমণ করতে পারছেন তারা।
রেলে ৪১ উন্নয়ন প্রকল্প চলমান: রেলওয়ে সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রেলওয়েকে আধুনিকায়ন ও যাত্রীবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়। এখন পর্যন্ত ৮৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রেলকে একটি আলাদা মন্ত্রণালয় হিসেবে গঠন করা হয়। এরপর থেকে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়ে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে চালিকাশক্তি হসেবে আবির্ভূত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন সারা দেশে ৪১টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রেলওয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মাগুরা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরে রেল চলবে। এছাড়া দেশের পর্যটনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার ও বান্দরবনও রেল সংযোগ পাচ্ছে।
এখন এডিবির অর্থায়নে প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে ১০০ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেললাইন। এই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬২ শতাংশ। গত ২২ সেপ্টম্বর এই রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। ওইদিন তিনি বলেন, কক্সবাজারে ট্রেন চালুর অপেক্ষায় দেশবাসী। ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হবে। কক্সবাজারে ট্রেন চালু হলে পর্যটক সমাগম ঘটবে ব্যাপকহারে। পর্যটকরা সাশ্রয়ী, আরামদায়ক ও নিরাপদ ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। এছাড়া সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা সম্ভব হবে। প্রবৃদ্ধি হবে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের।
রেলওয়ে সূত্র আরও জানায়, কক্সবাজারের মতো দেশের সব জেলায় রেল সংযোগ স্থাপনে ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২০৪৫) একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে ছয়টি পর্যায়ে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তখন আকাশপথ থেকে রেলপথ অনেক এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, অন্য পরিবহনের তুলনায় দেশের মানুষের প্রথম পছন্দ ট্রেন। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এই খাতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যাত্রীরা তার কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। তারপরও প্রতি বছর ট্রেনযাত্রীর চাহিদা বাড়ছে। এটা রেলওয়ের জন্য ইতিবাচক। এখন রেলকে যাত্রীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ আতঙ্ক: বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব মতে চলতি বছরের সেপ্টম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। এতে ২৯ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় ১০৩টি ট্রেনের জানালা ভেঙেছে। এর মধ্যে দেশের ১৫টি এলাকায় পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে বেশি।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, রেলকে যাত্রীবান্ধব করাই প্রধান লক্ষ্য। তবে কিছু এলাকায় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এটি বন্ধে তারা জনসচেতনতাসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর বাইরে রেলের জানালায় কাচের ওপর লোহার জাল দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। আশাকরি ক্রমান্বয়ে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা কমে আসবে।-জাগোনিউজ২৪.কম