বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩১১ কোটি ডলার। মহামারীসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের মধ্যেও চলতি বছরের জুন শেষে তা ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে এ দেড় বছরে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ৫৫৭ কোটি ডলার বেড়েছে। ডলারের বর্তমান বিনিময় হারকে হিসাবে নিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের এখনকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকারও বেশিতে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলার বা ৬৩ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৮৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেসরকারি খাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২৫ কোটি ডলার। পরের তিন বছর এ ঋণ বেড়েছে স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু গত বছর মহামারী শুরুর পর এ ঋণপ্রবাহ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। গত বছরেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মিলিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৪৭৬ কোটি ডলার, যা চলতি বছরের জুন শেষে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ৮৪ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনাসৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে উন্নত দেশ ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বিনিয়োগযোগ্য অলস তারল্যের পাহাড় গড়ে ওঠে। লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফারড রেট (লাইবর) নেমে আসে ইতিহাসের সর্বনিম্নে। এর সুবাদে দেশের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদেই বিদেশী ঋণ নিতে পেরেছে। এছাড়া উদ্যোক্তাদের বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং শর্তও এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সহজ হয়েছে। পুরনো বিদেশী ঋণ পরিশোধে ডেফারেল সুবিধাও (ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময়) পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের উচ্চপ্রবৃদ্ধির পেছনে এসব সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতে বিদেশী বিনিয়োগ বা ঋণকে অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এনে উদ্যোক্তারা যদি রফতানি খাতসহ অর্থনীতিতে বাড়তি অবদান রাখতে পারেন, সেটি ইতিবাচক। তবে দেখতে হবে, ঋণের অর্থ যথাযথ খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা। যথাসময়ে ঋণটি পরিশোধ করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদেশী ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার পরও মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাকে বিদেশী ঋণের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আরো কঠোর হবে।
দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি আটকে আছে ৮ শতাংশের ঘরে। লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেও তা বাড়ানো যায়নি। যদিও করোনাকালের দেড় বছরে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের ৪২ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত পাঁচ বছরের হিসাব ধরলে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞরা এখন বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের এ উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে সার্বিক অর্থনীতির জন্য বিপদের আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, দেশে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল। ঋণ পরিশোধের সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা উল্টো ক্ষতির মুখেও পড়তে পারেন। গত কয়েক বছরে সরকারও বড় বড় প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে সুদসহ এসব বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি ঋণ পরিশোধের চাপে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নড়বড়ে পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। বড় উদ্যোক্তারা দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিস্তিই ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না। একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদেশী ঋণকে ফাইন্যান্সিয়াল হেজিংয়ের আওতায় আনা হয়। এটি ডলারের মূল্য বৃদ্ধিজনিত সংকটের ঝুঁকি থেকে গ্রাহককে অনেকটাই সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশী ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে হেজিং সুবিধা নেই। ফলে ডলার বিনিময় বেড়ে গেলে স্বল্প সুদের যে সুবিধা উদ্যোক্তারা পেতেন, তা ডলারের বিনিময় হারেই উবে যাবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ হলো, দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ডলারের বিনিময় হার ৯০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদেশী ঋণ শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
দেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য উৎপাদন, টেক্সটাইল, ওষুধ, সিরামিক, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, সিমেন্ট, রাবার, প্লাস্টিক, তামাক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে ঋণ দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি খাতের প্রায় ৬৮৯ কোটি ডলার বিদেশী মেয়াদি ঋণের মধ্যে ট্রেড ক্রেডিট ও ডেট সিকিউরিটিজও রয়েছে। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে রয়েছে বায়ার্স ক্রেডিট, ডেফার্ড পেমেন্ট, রফতানি খাতের বিল ডিসকাউন্ট, বিদেশী ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র ও স্বল্পমেয়াদি ডেট লায়াবিলিটিজ।
বেসরকারি খাতে বিদেশী এ ঋণপ্রবাহের প্রধান মাধ্যম ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিট। দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে আছে ৩৬টির। এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (বিডা) অন্যান্য কিছু মাধ্যমেও বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বিতরণ হয়।
তিনটি ইউনিটের মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, এ মুহূর্তে বেসরকারি খাতের জন্য বিদেশী ঋণ অনেক বেশি সস্তা। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিদেশী ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াটিও অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। এ কারণে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যাংকগুলো অফশোর ব্যাংকিংয়ের পরিধি বড় করছে। অন্যদিকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছে। এসব কারণে বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
মুনিরুল মওলা বলেন, বিদেশী ঋণ নিতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জামানত বা গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে না। এ কারণে বড়রা এ ঋণ নিতে বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। গ্রাহকরাও নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করছেন। তবে বিদেশীদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে শুরু করলে সেটি দেশের জন্যই অমঙ্গল ডেকে আনবে।
দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের বিদেশী ঋণ গ্রহণের সবচেয়ে বড় উৎস হলো হংকং। দেশটি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৬৩ কোটি ৪১ লাখ ডলারের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ নিয়েছেন বাংলাদেশী শিল্পোদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণদাতা শীর্ষ ১০টি দেশ হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, জার্মানি, জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এছাড়া আন্তর্জাতিক বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও বিদেশী ঋণ নিচ্ছেন বাংলাদেশী শিল্পোদ্যোক্তারা।
লাইবর রেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক দশক আগে লাইবর ছিল ৬ শতাংশেরও বেশি। যদিও বর্তমানে লাইবরের সুদহার গড়ে দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। চলতি সপ্তাহে এক বছর মেয়াদি লাইবর সুদহার ছিল দশমিক ২৭ শতাংশ। ছয় মাস মেয়াদি লাইবর দশমিক ১৮ শতাংশ এবং এক মাসের কম মেয়াদ লাইবর দশমিক শূন্য ৯ শতাংশের নিচে নেমেছে। লাইবরের এ নিম্ন সুদহারকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশী বড় শিল্পোদ্যোক্তারা কমিশন, ফিসহ সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদে বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কম সুদের এ সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে দেশের উদ্যোক্তারা বিদেশী ঋণ নিয়ে বিপদে পড়তে পারেন বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতি আসার পর থেকেই দেশে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। তবে এরই মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে খোলাবাজারের বিনিময় হারে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়েছে। আগামীতে এ বিনিময় হার আরো বাড়বে। তখন কম সুদের বিদেশী ঋণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।
ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হারে এরই মধ্যে বড় ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মহামারী শুরুর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। আর ১০ নভেম্বর ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সায়। যদিও খুচরা বাজারে ডলারের বিনিময় হার এরই মধ্যে ৯০ টাকা ছুঁয়েছে। মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে এরই মধ্যে ১৬০ কোটির বেশি ডলার বাজারে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে।