প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার আইওআরএ সদস্য দেশগুলোর মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব অর্থনীতির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আইওআরএ সদস্য দেশগুলোকে সবুজ অর্থনীতির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’ রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠিত আইওআরএ’র সদস্যভূক্ত ১২টি দেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন।
ইন্ডিয়ান ওশান রিম আসোসিয়েশন (আইওআরএ) এর পরবর্তী সভাপতি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ ঢাকায় ২১তম আইওআরএ কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স (সিওএম) বৈঠকের আয়োজন করেছে।
বাংলাদেশে ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট হবে: দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার (১৭ নভেম্বর) সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খানের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের টানা চারবারের সংসদ সদস্য, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন মারা যাওয়ায় সংসদের রীতি অনুযায়ী শোক প্রস্তাব আনার পর তার জীবনের ওপর আলোচনার পর সংসদ মুলতবি হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়। আনোয়ার হোসেন খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মহামারি করোনা আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উৎপাদনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাকসিন নিয়ে অধিকতর গবেষণা ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনা ভাইরাসসহ বিভিন্ন ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং ভ্যাকসিন নীতিমালা প্রণয়নের পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের রয়েছে।’ ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট এবং ভ্যাকসিন নীতিমালা প্রণীত হলে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে, সেই তথ্যও তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
আমাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ অভিহিত করা হয়েছে: এ কে এম রহমতুল্লাহর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৫-২০২০ সময়কালে এসডিজি অর্জনে সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য আমাকে “এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড” প্রদান করা হয়। ওই সম্মাননা প্রদানকালে করোনা মহামারির এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশ ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকার জন্য আমাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ বলে অভিহিত করা হয়।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকোচন, ভ্যাকসিন বৈষম্য প্রভৃতি বিশ্বের অনেক দেশেরই উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। কিন্তু এই মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ যে অবিচলভাবে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছেÍএই পুরস্কার তারই বিশ্ব স্বীকৃতি। এই পুরস্কার শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে যেমন বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে, তেমনি বাংলাদেশের সক্ষমতার ওপর বিশ্ববাসীর আস্থা দৃঢ়তর করেছে। বাংলাদেশের জনগণই এই পুরস্কারের প্রকৃত অংশীদার।’
স্বাধীনতা অর্জন থেকে আজকের যত অর্জন, সবই হয়েছে দেশের মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসার জন্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই পদক দেশের জনগণকে উৎসর্গ করেন।
পদ্মা সেতুর ভৌত অগ্রগতি ৮৮.৭৫ শতাংশ: জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ভায়াডাক্টসহ ৯.৮৩ কি.মি. দৈর্ঘ্যের বাংলাদেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে। অক্টোবর, ২০২১ পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত কাজ ৮৮.৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। জুন, ২০২২ সালের মধ্যে স্বপ্নের এই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত ও সহজতর হবে। এটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হবে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে সাবওয়ে (আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো) নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে। অক্টোবর পর্যন্ত সমীক্ষা প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে এলাইনমেন্ট চূড়ান্ত করে যথাসময়ে সাবওয়ে বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়।’ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত ৭৪.৩৩ শতাংশ বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।
একাব্বর হোসেন ছিলেন নিষ্ঠাবান, সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নিষ্ঠাবান রাজনীতিকের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। টাঙ্গাইল-৭ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মরহুম একাব্বর হোসেনকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য গড়ে তুলছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আদর্শিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে একাব্বরও ছিলেন। আমাদের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য যাদের তৈরি করছিলাম, তাদের একজনকে হারালাম। এই মৃত্যু দেশ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। দুর্ভাগ্য তাকে হারালাম। সংসদ সদস্য একাব্বর হোসেনের মৃত্যুতে বুধবার (১৭ নভেম্বর) সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। বর্তমান সংসদের এই সদস্যের মৃত্যুতে সংসদের বৈঠকের শুরুতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে সর্বসম্মতক্রমে তা গ্রহণ করা হয়। এর আগে সংসদ নেতা শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন।
চলমান সংসদের কোনো সদস্য মারা গেলে সংসদের বৈঠকে শোক প্রস্তাব আনার পর তা নিয়ে আলোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। শোক প্রস্তাবের ওইদিন সংসদের অন্য কার্যক্রম স্থগিত রেখে বৈঠক মুলতবি করা হয়।
একাব্বর হোসেনকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়নের নিষ্ঠাবান রাজনীতিক কতটা প্রয়োজন তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। একাব্বর হোসেন ছিলেন এমন একজন নিষ্ঠাবান, সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ। একাব্বর থাকলে এদেশের রাজনীতিতে অনেক অবদান রাখতে পারতো। কারণ তার সততা ও একনিষ্ঠতা ও দেশপ্রেম। একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে যা সব থেকে বেশি প্রয়োজন। নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি যেমন ছিল। তিনি বলেন, আমাদের আবারও সেই শোক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রতিদিনই তার চিকিৎসার খবর নিচ্ছিলাম। খবর পেলাম তার আবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। লাইফসাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। তখনই আমার সন্দেহ হলো আর বোধহয় ফিরে আসবে না। সেই ঘটনাটাই ঘটলো।
আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার আমরা সংসদ শুরু করলাম- তখন সত্যি একটি আশ্বস্ত নিয়েই ছিলাম। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমরা সংসদের ২০ জন সদস্যকে হারিয়েছি। বলতে গেলে প্রতিবারই সংসদ শুরু করতে হতো শোক প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু শোক প্রস্তাব এবার নেওয়া হলেও কোনো এমপির মৃত্যুর জন্য আলোচনা করার দরকার হয়নি বলে আশ্বস্ত ছিলাম। স্বস্তি নিয়ে শুরু করলাম ঠিকই কিন্তু ভয়াবহ আঘাতটা এলো। তিনি বলেন, একটি সংসদে এতজন মানুষের মৃত্যু। সত্যিই যেন অস্বাভাবিক ঘটনা আামাদের জীবনে ঘটে গেলো। যারা দেশের মানুষের জন্য কাজ করছে- তারাই যেন একে একে চলে যাচ্ছে। একাব্বর হোসেন সক্রিয় একজন ছাত্রলীগকর্মী ছিলেন। এমন একটি সময় যে ছাত্রলীগ করতো তখন সামরিক জান্তা ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করাটা কঠিন ছিল। ছাত্ররাজনীতি করাটাও কঠিন ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাব্বর সবসময় সক্রিয় ছিলেন। তিনি আদর্শের প্রতীক ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ছিলেন ভালো সংগঠক। দেশ ও জনগণকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। ১৯৮১ সালের পর থেকে অনেক ঝড়ঝাপটা পার হয়ে আমাদের চলতে হয়েছে। পদে পদে বাধা। যেখানে সভা করতে গেছি বাধা। মিটিংয়ে বোমা হামলা থেকে শুরু করে মঞ্চ পোড়ানো। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে চলতে হয়েছে। একাব্বরদের মতো আমাদের নিবেদিতকর্মী যারা ছিল তারা সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সমাবেশ যোগ দিয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রাম গড়েছে। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল। কোনো সমাবেশের ডাক দিলেই ছুটে আসতো। আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে একাগ্রচিত্তে কাজ করেছে। তার অবদানটি কখনো ভোলার নয়।
তিনি বলেন, জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল। আত্মার সম্পর্ক ছিল যার কারণে সহজভাবে নির্বাচনে জিতে আসতো। নির্বাচনে নমিনেশন পাওয়ার পর সে কারও থেকে চাঁদা তোলা, টাকা নেওয়া কোনো কিছুই সে করেনি। মির্জাপুরের ওই এলাকায় আমাদের অনেক উন্নয়ন কাজ হয়েছে। সেখানে উন্নয়ন কাজে বাধা দেওয়া বা কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে সে ছিল না বরং প্রতিটি কাজ যাতে সহজভাবে হয় সেই প্রচেষ্টা তার মধ্যে দেখেছি। টাঙ্গাইলের উন্নয়নে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। প্রতিটি স্থায়ী কমিটিতে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। সড়কের সভাপতি হিসেবে উন্নয়নের ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশে খাদ্যের হাহাকার নেই: প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ থেকে বাংলাদেশকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের মানুষের জীবনযাত্রী সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। সারাবিশ্ব এটা মনে করে; আমাদের বলে। বিশ্বের অবস্থা দেখলেও উপলব্ধি করতে পারি। অনেক উন্নত দেশেও খাদ্যের অভাব। দুর্ভিক্ষ অবস্থা। বাজারে জিনিস পাওয়া যায় না। সুপার মার্কেটগুলো খালি। লন্ডনে গিয়ে শুনতে হচ্ছে সুপার মার্কেটে অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। সাপ্লাই নেই। খাবার জিনিস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রামে পর্যন্ত খাদ্যের হাহাকারটা নেই।