নভেম্বরের শুরুতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে গেলে ৩ নভেম্বর দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। জ্বালানি বিভাগ থেকে দেয়া মূল্যবৃদ্ধির ওই ঘোষণায় বলা হয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে গেলে দেশের বাজারেও কমানো হবে। তবে কত টাকা কমলে দেশের বাজারে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমানো হবে তা জানানো হয়নি বিজ্ঞপ্তিতে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কয়েক সপ্তাহ পর আবার কিছুটা নি¤œমুখী হয়েছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২-১৪ ডলার কমে যাওয়ায় তেল বিক্রিতে লাভের ধারায় ফিরেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। টানা কয়েক মাস অব্যাহত লোকসানের পর নভেম্বর থেকে ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রিতে সংস্থাটি মুনাফা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গত মাসে ডিজেল ও কেরোসিন বিক্রিতে লিটারপ্রতি ১ টাকার বেশি মুনাফা করে বিপিসি, যা চলতি মাসে আরো বেড়েছে।
জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসি বলছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য এখনো স্থিতিশীল পর্যায়ে আসেনি। এক সপ্তাহ আগে যে মূল্য ছিল এখন তা আরো বেড়েছে। তেলের বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসি। মূল্য পরিস্থিতি আরো পর্যবেক্ষণ করা দরকার বলে জানান জ্বালানিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশনস ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা কমে যাওয়ায় বিপিসি লাভের ধারায় ফিরেছে। তবে তেলের বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত দেশের বাজারে মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। বিপিসির লাভের ধারা কতদিন বজায় থাকবে, সেটিও দেখার বিষয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে একদিন দাম কমলে পরের দিন আবার বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যে বাজার পর্যবেক্ষণ এবং একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হলে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। জ্বালানি তেলের বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান অয়েলপ্রাইসডটকমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জ্বালানি তেলের মূল্যে বড় ধরনের পতন হয়। বিশেষত তেল সংকট কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২১ নভেম্বর রিজার্ভ থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যারেলপ্রতি ১০-১২ ডলার কমে যায়।
অয়েলপ্রাইসের তথ্য অনুযায়ী, ১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৪ ডলার ১৫ সেন্ট। সর্বশেষ ১৭ ডিসেম্বর ব্যারেলপ্রতি কমে ৭০ ডলার ৮৬ সেন্টে এসেছে। গত দেড় মাসের ব্যবধানে ব্যারেলপ্রতি ১৩ ডলার ২৯ সেন্ট কমেছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ক্রুড অয়েলের ২০ অক্টোবর সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ৮৫ ডলার ৮২ সেন্ট। ১৭ ডিসেম্বর পণ্যটির দাম কমে ব্যারেলপ্রতি ৭৩ ডলার ৫২ সেন্ট দাঁড়িয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে ক্রুড অয়েলে ব্যারেলপ্রতি ১২ ডলার শূন্য ২ সেন্ট কমেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন ৭০-৭২ ডলারে ওঠানামা করছে, তখন বিপিসি লাভের ধারায় ফিরছে। জুন থেকে টানা পাঁচ মাস জ্বালানি তেলে লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ১ টাকা ৫ পয়সা এবং ডিসেম্বরে ২ টাকা করে লাভ করছে। এর আগে জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছিল, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপিসি তেল বিক্রিতে লোকসান করেছে। জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ২ টাকা ৯৭ পয়সা লোকসান হয় বিপিসির। পরের তিন মাসে সংস্থাটির লিটারপ্রতি লোকসান হয় যথাক্রমে ৩ টাকা ৭ পয়সা, ১ টাকা ৫৮ পয়সা ও ৫ টাকা ৬২ পয়সা। অক্টোবরে ডিজেল ও কেরোসিনে বিপিসির লোকসান প্রতি লিটারে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ টাকা ১ পয়সা। চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর সময়ে এ দুই জ্বালানি পণ্যে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, দেশে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অন্তত ১৭ হাজার টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল। বিপিসি লাভের ধারায় ফিরলে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমালেও আসন্ন সেচ মৌসুমে কিছুটা সাশ্রয়ী হবেন কৃষকরা। সেচ মৌসুমে দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ ডিজেলের চাহিদা তৈরি হয়, তাতে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় হয় কৃষকদের। চলতি মৌসুমে ডিজেলে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।
বিপিসির দাবি, জ্বালানি তেলে সংস্থাটিকে মুনাফা করতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেলের দাম ৬৭-৬৮ ডলারের নিচে থাকা প্রয়োজন। দাম এর বেশি হলে লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাদের। জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা কমেছে। তবে স্থিতিশীল পর্যায়ে আসেনি। কয়েক মাসব্যাপী যদি একটা নির্দিষ্ট দামে জ্বালানি তেলের মূল্য স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব। ওমিক্রন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য দেশের বাজারে মূল্য কমাতে হলে আরো অপেক্ষা করতে হবে।