রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০১:৪৮ অপরাহ্ন

অবৈধ ইটভাটা: হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য

মোঃ রায়হান উদ্দীন
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার লোহাগাড়ায় ইটভাটার কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লোহাগাড়া উপজেলায় ৪৯টি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার প্রভাবশালী মালিকরা প্রসাশনে মিথ্যা তথ্য উপাস্থাপন করে ছাড়পত্র নিয়ে বৈধতার দোহাই দিয়ে অবৈধভাবে এই সব ইটভাটা চালাচ্ছে বলে পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেছেন। বনের কাঠ পুড়ে, পাহাড় ও কৃষি জমির মাটি কেটে হাসপাতাল, স্কুল মাদ্রসা, পাহাড়, ঘনবসতি ও কৃষি জমির পাশেই গড়ে তুলছে অসংখ্য ইটভাটা। এইসব ইটভাটার কালো ধোয়ায় পরিবেশ ও জনসাধারনের জীবন মারাত্মক হুমকিতে। অথচ এভাবে ইটভাটা পরিচলনা করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,আধুনগর ইউনিয়নের কিউবিএম ব্রিকস ইটভাটার অনুমানিক ১০০মিটার উত্তরে কিন্ডার গার্ডেন স্কুল, একাডেমি, হাফেজ খানা, আনুমানিক ৮০০মিটার উত্তরে আধুনগর ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা ও বাজার। আনুমানিক ৪০০মিটার পশ্চিমে হাতিয়ার পুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গুলএজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বাজার, ঘনবসতি। ৬০০মিটার পূর্বে চেঁদিপুনি বড়ুয়া পাড়ায় হাজী মোস্তাক আহমদ উচ্চ বিদ্যালয় ও ঘনবসতি। আমিরাবাদ ইউনিয়নের দরবেশ হাটের সামান্য পূর্বদিকে গড়ে তুলে এসএসবি ইটভাটায়ার অনুমানিক ৮০০মিটার দক্ষিনে গৌরসুন্দর হাইস্কুল, পূর্বদিকে কালিবাড়ী হাইস্কুল ও মন্দির। এই দুই ইটভাটার চার পাশে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঘনবসতী, উপাসনালয় ও কৃষি জমি থাকা সত্ত্বে ও চলতি বছরে ‘কিউবিএম ও এসএসবি’ ইটভাটার মালিক শাহাব উদ্দীনের নামে ছাড়পত্র ইস্যু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে অসৎ উপায়ে এই সব ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। অভিযোগের জবাবে শাহাব উদ্দীন চৌধুরী জানান, লোহাগাড়ার সব ইটভাটা অবৈধভাবে কাঠ পুড়ছে, আমার দুই ইটভার নামে অনুমোদন আছে। আমিরাবাদ দরবেশহাটের পূর্বদিকে ৪টি, কলাউজানে ৫টি, বড়হাতিয়া ৪টি, পদুয়া ৭টি লোহাগাড়া ৬টি, চরম্বা ২১টি, অবৈধ ইটভাটা গড়ে তুলেছে। লোহাগাড়ার প্রভাবশালী ইটভাটার মালিক শাহাব উদ্দীন চৌধুরী, সভাপতি আবিদ হাসান মনু সেক্রেটারী সরোয়ার হোসেন,মুহাম্মদ পারভেজ,হারেছ কোম্পানীসহ আরো একাধিক ইটভাটার মালিক প্রশাসনের বিভিন্ন সহযোগিতায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে অমান্য করে এইসব অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা করে যাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও সাতকানিয়া মৌলভীর দোকান থেকে শুরু করে ঠাকুর দিঘী পর্যন্ত রাস্তার পূর্বে ও পশ্চিম পাশে অনুমানিক ২ কিলোমিটারের মধ্যে ৪০টিরও বেশি ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তুলছে ম্যানেজ করা অবৈধ ছাড়পত্রের অবৈধ ইটভাটা। সাতকানিয়া রসুলবাগ এলাকায় অবস্থিত ‘মেসার্স শাহ আমানত ব্রিকস ম্যানু-১’ নামের একটি ইটভাটা। এ ইটভাটার ৫৫০ মিটার দূরে রয়েছে আলহাজ্ব জাফর আহমেদ চৌধুরী কলেজ ও ৬৭০ মিটার দূরে আছে ৬১ নম্বর রসুলবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,রসুলবাগ ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, আসমা মফজল গার্লস হাইস্কুল ও হজরত শাহ ছৈয়দ মক্কী (ও.) ইনস্টিটিউট নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাতকানিয়া মৌলভীর দোকান এলাকায় মো সোলায়মান এর মালিকানাধীন দুটি ইটভাটা ‘মেসার্স শাহ আমানত ব্রিকস-১ ও মেসার্স শাহ আমানত ব্রিকস’- নামে দুই ইটভাটার চারপাশে রয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাতকানিয়া রসুলবাগে রয়েছে মো. করিম উদ্দিনের মালিকানাধীন মেসার্স সাঙ্গু মডার্ন ব্রিকস’ এ ইটভাটার মাত্র ৩৫০ মিটার দূরে আলহাজ জাফর আহমেদ চৌধুরী কলেজ, ৩২০মিটার দূরে ৬১নম্বর রসুলবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রসুলবাদ ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, আসমা মফজল গার্লস হাইস্কুল ও হজরত শাহ ছৈয়দ মক্কী (র.) ইন্সটিটিউট। সাকতনিয়া কেরানীহাট নয়াপাড়া এলাকায় সামসুল ইসলামের মালিকানাধীন দুটি ইটভাটা- ‘মেসার্স সেভেন স্টার ব্রিকস ও মেসার্স সেভেন স্টার ব্রিকস-২’ রয়েছে। এ দুটি ইটভাটার পাশেই রয়েছে মাদারবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আফজল নগর শাহ দেওয়ান আলী ও ফকির মাওলানা (রহ.) দাখিল মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সাতকানিয়া কেরানীহাট তেমুহনীতে রয়েছে সাহেব মিয়ার মালিকানাধীন ‘মেসার্স শাহজালাল ব্রিকস-১’ এ ইটভাটার ৯৩০ মিটার দূরে আছে অলকেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং সাতকানিয়া পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সাতকানিয়া উপজেলার ছনখোলায় রয়েছে মো: ওবাইদুল কাদেরের মালিকানাধীন ‘উত্তরা ব্রিকস‘ নামে ইটভাটা। এ ইটভাটার উত্তর-পূর্ব দিকে আনুমানিক ৩০০ মিটার দূরে আছে ১০ ফুট উচ্চতার টিলা ও ৪৫০ মিটার দূরে আছে ৮০ ফুট উচ্চতার পাহাড়। সাতকানিয়ার লটমনি এওচিয়ায় রয়েছে নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন মেসার্স খাজা ব্রিকস। এ ইটভাটা চিমনির দক্ষিণ দিকে ৬১০ মিটার দূরে ছনখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫২০ মিটার দূরে দারুল ইমাম ইসলামিয়া মাদ্রাসা এবং মারকাজু তাহফিজিল কুরআন ফোরকানিয়া মাদ্রাসা) রয়েছে। সাতকানিয়া নামার বিলে রয়েছে মোহাম্মদ আলীর মালিকানাধীন ‘মেসার্স আলী রজা (রা.) ব্রিকস’ এ ইটভাটার ৭০০ মিটার দূরে দক্ষিণ মরফলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,উত্তর দিকে ৫৮০ মিটার দূরে সুলতান আহমেদ চেয়ারম্যান তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসা এবং মারফলা কমিউনিটি ক্লিনিক নামে প্রতিষ্ঠান আছে। এছাড়া ও সাতকানিয়া আরও বিভিন্ন ইউনিয়নে রয়াছে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা। লোহাগাড়া সাতকানিয়া ইটভার চার পাশে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, পাহাড়, টিলা, কৃষি জমি ও গণবসতি থাকা সত্তে ও এবছরে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রভাবশালী মালিকদের সাথে যোগসাজে ইটভাটার নামে ছাড়পত্র দেওয়ার কারণে স্থানীয় ও পরিবেশবাদীদের মুখে নানা রকমের প্রশ্ন। এছাড়াপত্রের মেয়াদ রয়েছে ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আইনে আছে-ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯)অনুসারে বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান হতে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবেনা। অথচ দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ ছাড়পত্রের অবৈধ ইটভাটা। এই ইটভাটা গুলো অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিয়মনীতির বিন্ধু মাত্রও তোয়াক্কা করা হয়নি। গত ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন(এইচআরপিবি)পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। সেই রিটের শুনানি নিয়ে সাত দিনের মধ্যে চট্টগ্রামে অবৈধভাবে পরিচালিত সব ইটভাটা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের সেসব নির্দেশনা অনুসারে চট্টগ্রাম প্রশাসন কার্যক্রম শুরু করলেও কিছু কিছু জায়গায় অবৈধ ইটভাটা বন্ধ না করে শুধু জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় হাইকোর্টের আদেশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করায় চট্টগ্রাম প্রশাসনের দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন রিটকারীরা। পরে গত ৩১ জানুয়ারি বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হাসান মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় চলমান অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধের আবারও নির্দেশ দেন। এরপর ইটভাটা মালিকরা একটি আবেদন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল করলেও সে আপীল খারিজ করে দেন। গত বছর হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টের চট্টগ্রামের অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বার বার নির্দেশনা থাকলেও সেই নির্দেশনা অমান্য করে এই বছরেও পরিবেশ অধিদপ্তরের অবৈধ ছাড়পত্র নিয়ে চালু করেছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রসাশক জানান বৈধ-অবৈধ ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষমতা পরিবেশ অধিদপ্তরের সেখানে আমার করার কিছুই নেই।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com