লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে পবিত্র ঈদেও থামছে না জেলে পল্লির কান্না। ভরা মৌসুমে মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলেদের ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে গেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মাঝেও মানুষ ঈদের কেনাকাটা করতে ব্যস্ত ছিল। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দিন-রাত বাজারে ছিল মানুষের আনাগোনা। কিন্তু মেঘনা উপকূলের দরিদ্র মানুষগুলো পারেনি কেনাকাটা করতে। তাদের মনেও আসেনি যে ঈদ এসে গেছে। নতুন জামা কাপড় কিনতে হবে নিজ ও পরিবারের সদস্যদের জন্য। তবে তাদের একটাই চিন্তা নদীতে মাছ ধরবে আর বিক্রি করে খাবারের চাল কিনবে। কারণ তাদের কাছে ঈদের চেয়ে পেট পুরে খাওয়ার যোগানটায় বড় আনন্দের। কিন্তু নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ায় ঈদেও ওদের আকাশটা ঘোলাটে থাকবে।
মার্চ-এপ্রিল দুই মাস লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত মেঘনা নদী এলাকায় সকল প্রজাতির মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সরকারি নির্দেশ মেনে প্রায় ৯৫ শতাংশ জেলেই নামেনি নদীতে। বাকি জেলেরা গোপনে নদীতে নেমে মাছ শিকার করেছে। এদেরমধ্যে অনেকেই প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে গুণতে হয়েছে জেল ও জরিমানা।
নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার বন্ধ থাকায় সরকার থেকে এ উপজেলার ৭ হাজার জেলেকে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ উপজেলায় সরকারি হিসেবে প্রায় ১৪ হাজার জেলে রয়েছেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি সুবিধা পান অর্ধেকেরও কম জেলে। এতে সংসার খরচ, দাদনদার ও ধারদেনা পরিশোধ করার চিন্তা নিয়েই ঝুঁকি নিয়ে নদীতে গিয়ে জেল-জরিমানার শিকার হতে হয়। সঙ্গে লাখ লাখ টাকার জাল ও নৌকাও হারাতে হয় তাদের।
ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে নদীতে কারেন্ট জাল ব্যবহার করা সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও ব্যবহার বন্ধ করছে না জেলেরা। প্রশাসনের বিভিন্ন অভিযানে বেহুন্দি ও কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু জেলেরা ধারদেনা ও দাদনদারের কাছে সুদে টাকা নিয়ে জালগুলো কেনে। পুড়ে ফেললে পুরোটাই ক্ষতি জেলের। প্রশাসন কিংবা সচেতন মহল কেউই বিষয়টি চিন্তা করে না। তবে জেলেদের দাবি, তারা বাজারে কারেন্ট জাল পায় বলেই কিনে। যদি এটি উৎপাদন বন্ধ হতো, তাহলে তারাও কিনতে পারতো না। উৎপাদককে কেউই শাস্তি দিচ্ছে না। যত শাস্তি গরিব জেলেদের।
ঈদুল ফিতরের আনন্দ জেলে পল্লীর জন্য নয়। জেলে পল্লীর প্রধান ঈদ হচ্ছে পেট পুরে খেতে পারা। ছেলেমেয়েদের পাতে মাছের পাশাপাশি এক টুকরো মুরগির মাংস তুলে দেওয়া। কিন্তু ভাগ্যটা তাদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস পর মে মাসের প্রথম দিন তারা নদীতে নেমেছিল। দুই মাস পর আনন্দ-উৎসব নিয়ে নদীতে গেলেও মিলছে না কাঙ্খিত ইলিশ। কোনরকম নৌকার তেল খরচ ও জেলেদের হাত খরচই জোটে। চাল কিনতেও তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের জামা কিনবে কোথা থেকে ? এই করোনাতে সরকারি, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। তবে সব শহর, মফস্বল শহরে অসহায়দের মাঝেই থেকে গেছে। পিছিয়ে রয়েছে গ্রামের অস্বচ্ছল মানুষগুলো। তাদের পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারেনি ছবি তোলার ভীড়ে। আর জেলে পরিবারগুলোতে এর থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত।
আসলে মেঘ না থাকলেও, মেঘনায় ইলিশ মেলা পর্যন্ত জেলেদের জন্য আকাশটা অন্ধকার থাকে। সূর্যের আলো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও সেই অন্ধকার ছাড়াতে পারে না। একমাত্র বিধাতার ইচ্ছাতেই তাদের আকাশটা আলোয় পরিণত হয়। তবে করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের এই ক্রান্তিলগ্নে পাওয়া ঈদটিতে জেলেদের ভাগ্যে রয়েছে ঘোলাটে অন্ধকার।
মফ/প্রিন্স/খবরপত্র