২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ছিল ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। যদিও গত অর্থবছরের সমায়িক হিসাবে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ধরা হয়েছিল ৩০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিবিএস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে মোট বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে জিডিপি যে হারে বেড়েছে, সেই হারে বিনিয়োগ বাড়েনি। এজন্য বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত কিছুটা কমেছে।
জানা গেছে, কভিড-১৯ মহামারীর শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও মহামারী পরিস্থিতির অবনতি হলে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু বিবিএস বলছে, গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছুঁই ছুঁই।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমাদের এ হিসাব কার্যক্রমে পূর্ণাঙ্গ আস্থা ও বিশ্বাস আছে। এ তথ্য আমরা ধারণ করি এবং এর পক্ষেই থাকব। বিশ্বব্যাংকের জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম নেই। তারা তাদের একটি পদ্ধতি অনুসারে দেশের জিডিপি হিসাব করে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির এ হিসাব দেখার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটি রয়েছে। সেখানে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা থাকেন। পরিসংখ্যানবিদরা থাকেন। ফলে আমার বিশ্বাস, আমাদের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তবে কেউ যদি যৌক্তিকভাবে হিসাব কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, তাহলে সেটিকে আমরা স্বাগত জানাব।
গত বছরের নভেম্বরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সাময়িক হিসাবে সংস্থাটি বলেছিল, মাথাপিছু আয় হয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। তবে বিবিএসের চূড়ান্ত হিসাব বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির আকার হয়েছে ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মাথাপিছু আয় হয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার। গত মঙ্গলবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম।
যদিও বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ঘরেই ছিল। আবার ওই অর্থবছরে দেশের মোট বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে উল্টো কমে গেছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের নয় মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে সাময়িক হিসাব দিয়েছিল বিবিএস। এর পরের তিন মাস অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ছিল বেশ অস্থিরতা। কভিড-১৯ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ছিল গতিহীনতা। কিন্তু চূড়ান্ত তথ্যে জিডিপি ও প্রবৃদ্ধির হার দুটিই বেড়েছে। গত বছরের সাময়িক হিসাবে বিবিএস জানিয়েছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও জিডিপির আকার ছিল ৪১১ বিলিয়ন ডলার। চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছরে জিডিপি বেড়ে ৪১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। টাকার অংকে জিডিপির আকার ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি। খাতভিত্তিক প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে শিল্প খাত। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ, অন্যদিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭৩ ও কৃষি খাতে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।
শেষ তিন মাসে কী এমন মিরাকল ঘটেছে, যার জন্য প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে অর্থনীতির সূচকের উল্লম্ফন? বণিক বার্তার এমন প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, স¤প্রতি আমাদের রফতানি বেড়েছে, পাশাপাশি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে। তাছাড়া কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাগুলো সঠিক সময়ে সঠিকভাবে নেয়া হয়েছে বিধায় অর্থনীতি সাবেক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এখানে কোনো ম্যাজিক নেই। এটি প্রত্যাশিত ছিল।
বৈশ্বিক বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা দেশের জিডিপি ও অন্যান্য সূচক নিয়ে যখন প্রশ্ন তুলছে তখন এ তথ্য আসলে কতটা গ্রহণযোগ্য, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা জাতিসংঘের স্বীকৃত মেথড অনুযায়ী জিডিপির হিসাব করি। বৈশ্বিক সংস্থাগুলো অনেক সময় রক্ষণশীলতার পরিচয় দেয়। তাদের হিসাব অনেক সময় সাবজেকটিভ হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা আমাদের হিসাবটাই গ্রহণ করে। সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে বস্তুনিষ্ঠভাবে এ হিসাব করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বৈশ্বিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি।
যদিও এসব তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে জিডিপির এ হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। কোন তথ্যটা বস্তুনিষ্ঠ তার ব্যাখ্যা দিলে জিডিপির বিষয়ে মানুষের মধ্যে প্রকৃত বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হতো। বিবিএসের হিসাবই যদি আমলে নিই তাহলে দেখা যাবে, রফতানির চেয়ে আমদানির প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। ফলে রিসোর্স ব্যালান্স বা নিট এক্সপোর্ট নেতিবাচক হয়েছে, যা জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার সরকারি প্রকৃত ব্যয় খুব বেশি বাড়েনি। কভিডকালে ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগও ছিল একেবারেই কম। কেননা অনেক কিছুই সাময়িক কিংবা প্রকৃতভাবে বন্ধ ছিল। ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি ছিল না। ফলে বিবিএসের হিসাব বিবেচনায় নিলেও প্রবৃদ্ধি এত হওয়ার সুযোগ নেই। সাময়িক হিসাব যেটা ছিল সেটি অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিক ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত হিসাব অনেকটাই বাস্তবতা বিবর্জিত।
গত বছরের নভেম্বরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়েছিল বিবিএস। সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৫৪ ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে যা ছিল ২ হাজার ৩২৬ ডলার। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার, টাকায় যা ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। ফলে অর্থবছরের ব্যবধানে টাকার অংকে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২২ হাজার ৫৩৯ টাকা। জিডিপি হিসাব করার জন্য নতুন ভিত্তিবছর চূড়ান্ত করেছে বিবিএস। ২০১৫-১৬ ভিত্তিবছর ধরে এখন থেকে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, মাথাপিছু আয় গণনা করা হচ্ছে। আগে ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে এসব গণনা করা হতো। উল্লেখ্য, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিট্যান্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় বের করা হয়।