সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন

ওমিক্রনে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা

ডা. সেলিনা সুলতানা:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

করোনাভাইরাসের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় তৃতীয়বারে শিশুদের সংক্রমণের হার দ্রুত গতিতে বেড়েছে। ওমিক্রনের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ আফ্রিকার পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের উপর ওমিক্রন জোরদার প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে যেসব শিশুরা কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত কিংবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে ওমিক্রন বেশি প্রভাব ফেলে। যা আগের কোনো ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
ওমিকনে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকেই দ্রুত ভাইরাসটি শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই মনে করেন শিশুদের উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে কোভিডের ঝুঁকি কম, তাই শিশুদের যতেœও অবহেলা করেন। যা বিপদ ডেকে আনছে। এদিকে শিশুদের কোয়ারান্টিনে রাখাও সম্ভব হয় না। এ কারণে পরিবারের সদস্যদের থেকে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিশুদের নমুনা পরীক্ষাও কম করা হয়, ফলে তাদের আক্রান্ত হওয়ার তথ্য খুব কম থাকে।
করোনাভাইরাসের উপসর্গগুলো সাধারণ সর্দি-কাশির লক্ষণগুলোর মতোই। যদিও শিশুদের ঠান্ডা লাগা একটি নিয়মিত ঘটনা, তাই অভিভাবকরা সাধারণ ঠান্ডা ও কোভিভের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছেন না। এজন্যই বেড়ে যাচ্ছে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি। সম্প্রতি আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্সর (এএপি) তরফ থেকে একটি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে শিমুর হার ১৭.৪ শতাংশ। শুধু আমেরিকাতেই প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ১১ হাজার ২৫৫ জন।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট হলো সার্স-কোভ-২ এর একটি রূপ যা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রথম রিপোর্ট করা হয়েছিল। ব্রঙ্কি (ফুসফুসের শ্বাসনালী) মধ্যে ওমিক্রন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর চেয়ে প্রায় ৭০ গুণ দ্রুত গতিতে চলতে পারে। এটি পূর্ববর্তী স্ট্রেনের তুলনায় কম গুরুতর। ওমিক্রন সংক্রমণ ডেল্টা ভেরিয়েন্টের তুলনায় ৯১ শতাংশ কম মারাত্মক, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি ৫১ শতাংশ কম। এ ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণ-ক্ষমতা, তীব্রতা ও পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য গবেষণা চলছে।
যখন একটি ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অসংখ্য সংক্রমণ ঘটায়, তখন ভাইরাসের মিউটেশন বা পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একটি ভাইরাস যত বেশি ছড়ায়, ততো বেশি তা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্ট এখন বিশ্বের ৫৭টি দেশে শনাক্ত হয়েছে। ওমিক্রনের ফলে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে প্রধানত জ্বর, সর্দি, ক্লান্তি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, কাশির উপসর্গ নিয়ে। ছোটদের ক্ষেত্রে কাশিটা ওঠে গলা থেকে। গলায় কিছু আটকে গেলে বা বিষম খেলে যে ধরনের শুকনো কাশি হয়, ছোটদের এই কাশিকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় ‘ক্রাপ’। এ ধরনের কাশির দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর রাখতে হবে।
সাধারণ ফ্লু বা ভাইরাল ফিভার এর সঙ্গে ওমিক্রনের পার্থক্য খুঁজে বের করা সহজ নয়। কোভিডের এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট খুব তাড়াতাড়ি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। শিশুদের শরীরেও জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা ব্যথার মতো বা সাধারণ ঠান্ডা লাগার উপসর্গই থাকবে বলে অভিমত চিকিৎসকদের।
ফলে সাধারণ ফ্লু বা ভাইরাল ফিভারের সঙ্গে ওমিক্রনের কোনো পার্থক্য করা যাচ্ছে না। অভিভাবকরা একে সাধারণ ঠান্ডা কাশি ভেবে ঘরেই রাখছেন। এখনো দেশে ছোটদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। ওমিক্রন থেকে শিশুদের রক্ষা করার ভালো উপায় হল কোভিডের আচরণ লক্ষ্য করা। বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্করা কোভিড পজিটিভ হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। দীর্ঘসময় ধরে মাস্ক পরতে না চাইলেও তাদের মাস্ক পরানোর অভ্যাস করতে হবে। ফলে সংক্রামিতের কাছে গেলেও শিশুটি অনেকটা সুরক্ষিত থাকবে। ঠান্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে এরকম সংক্রমণ পরিবারে শিশুদের যেতে দেওয়া যাবে না। ছোটরা বড়দের অনুকরণ করতে পছন্দ করে। প্রাপ্তবয়স্করা যদি সঠিক নিয়মে মাস্ক পরেন, তাহলে শিশুও মাস্ক পরতে শিখবে।
একই সঙ্গে শিশুর খাদ্যতালিকায় ভিটামিন ও মাল্টিভিটামিন রাখবেন। বিশেষ করে ভিটামিন ডি বেশি করে খেতে হবে, কারণ ভিটামিন ডি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
এ ছাড়াও সুষম খাবার খাওয়া, যোগাসন করা, খেলাধুলায় থাকা, বারবার স্যানিটাইজ করা, বাইরের প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া- এগুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
নবজাতকের জন্য ও সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কোভিড সংক্রমণের কোনও প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তাই কোভিড পজিটিভ মায়েদের শিশুকে দুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নবজাতকের যতœ নেওয়ার সময় বাবা-মায়েরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, শিশুর চারপাশ বা সংস্পর্শে এলে মাস্ক পরতে হবে, ঘন ঘন হাত ধুতে হবে, কোভিডের টিকা সম্পূর্ণ করতে হবে, শিশুকে ফ্লু শট দিতে হবে।
জনসমাবেশ ও আত্মীয়দের ভিড়ে কখনো শিশুকে নিয়ে যাওয়া যাবে না, বাড়িতে কোভিড পজিটিভ কেউ থাকলে, তার ধারে কাছে শিশু ও অভিভাবকেরা যাবেন না। এ সময় বাড়িতে অন্য অতিথিদের আসারও অনুমতি দেওয়া যাবে না। প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেককে টিকার সব ডোজ সম্পন্ন করতে হবে। প্রয়োজনে বুস্টার ডোজ নিতে হবে বয়স অনুযায়ী। আসলে কোভিভ থেকে শিশুদের রক্ষা করার সর্বোত্তম উপায় হলো মায়েদের টিকা নিশ্চিত করা ও গর্ভবতী মায়েদের টিকা দিতে উৎসাহিত করা। কারণ উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবডি শিশুদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয় ও তা শিশুর জীবনের মূল্যবান প্রথম কয়েক মাস সুরক্ষিত রাখে। গবেষকরা কোভিড-১৯ টিকার কার্যকারিতার উপর ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সম্ভাব্য প্রভাব খতিয়ে দেখছেন। ভ্যাকসিন সাধারণ অসুস্থতা, মারাত্মক অসুস্থতা ও মৃত্যু ঝুঁকি কমায় ও সংক্রমণ থেকে রাঁচায়। প্রাথমিকভাবে যেসব গবেষণা হয়েছে, তা থেকে দেখা যায়, ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্ট ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্টের তুলনায় কম মারাত্মক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ওমিক্রনকে ‘মৃদু’ বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয় বলে সতর্ক করেছে। কোভিড-১৯ এর সব ধরনই মারাত্মক রোগের বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। শিশুর মধ্যেও এ নিয়ে উদ্বেগ কাজ করছে বলে ধরে নিতে হবে। তারা অনলাইন ও টিভিতে যা দেখছে বা অন্যদের কাছ থেকে এই ভাইরাস সম্পর্কে যা শুনছে, তা বোঝা তাদের জন্য কঠিন হচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যেও উদ্বেগ, চাপ ও দুঃখবোধ তৈরি হচ্ছে। এ সময় শিশুর উদ্বেগের বিষয়গুলোকে কখনো ছোট করে দেখবেন না। মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হবে। বিশ্বজুড়ে যা চলছে সে বিষয়ে জানার অধিকার শিশুদেরও আছে। তাদের বয়স অনুযায়ী কথা বলতে হবে, তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তা খেয়াল করে তাদের উদ্বেগের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। শিশুরা নিজেদের ও তাদের বন্ধুদের কীভাবে রক্ষা করতে পারে, তা বোঝাতে হবে। হাঁচি-কাশির সময় কীভাবে হাত ভাঁজ করে কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢাকতে হয় তা দেখাতে পারেন। বুঝিয়ে বলতে হবে করোনা উপসর্গ কোনগুলো।
যাদের করোনা উপসর্গ আছে তাদের কাছে যেন শিশুরা না যায় তা বুঝিয়ে বলুন। জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট বোধ করলে যেন অবশ্যই বাবা-মাকে জানায়। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুকে মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে হবে। যতটা সম্ভব সময় দিতে হবে শিশুকে।
করোনাভাইরাস আরও বেশি সংক্রামক হতে পারে, যে কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই বলে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানুয়ারির ১-৩১ তারিখ পর্যন্ত মোট যে মৃত্যু হয়েছে, তাতে প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণ করেননি ও মৃত্যুবরণ করেছেন। বাকিরা ভ্যাকসিন পেয়েছেন।
সর্বোপরি শিশুদের জন্য যত দ্রুত সম্ভব টিকার ব্যবস্থা করতে হবে, ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য করোনার টিকা আনছে ফাইজার ও বায়োএনটেক। টিকার জরুরি ব্যবহারের জন্য আবেদন করছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এফডিএ।
অনুমোদন পেলেই এ মাসের শেষ নাগাদ ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের করোনার টিকা আসবে। ওমিক্রন দ্রুত ছড়াচ্ছে। যেহেতু এ মুহূর্তে শিশুদের জন্য টিকা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের ফ্লুর টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা।
লেখক: ডা. সেলিনা সুলতানা,কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার অ্যান্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com