ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। ধীরগতির নির্মাণকাজে ব্যাপক জনভোগান্তি তৈরি করছে এ প্রকল্প। এর মধ্যে আবার প্রকল্পটিতে দেখা দিয়েছে অর্থ সংকট। প্রকল্পের দুই চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দিতে পারছে না। ফলে ধীরগতিতে চলা এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিআরটি প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিকাদারদের অর্থ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা।
চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড পৃথকভাবে বাস্তবায়ন করছে বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। নিয়ম অনুযায়ী, ঠিকাদার একটা নির্দিষ্ট অংশের কাজ নিজের টাকায় বাস্তবায়ন করবে। তারপর সে অনুযায়ী বিল দাখিল করলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেই বিল পরিশোধ করবে। কিন্তু চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এ টাকার সংস্থান প্রয়োজন অনুযায়ী করতে পারছে না, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে প্রকল্পটির নির্মাণকাজে।
চীনের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বিআরটি প্রকল্পের একমাত্র বড় সমস্যা ঠিকাদারদের অর্থ সংকট। এ কারণে তারা শুরু থেকেই ধীরগতিতে কাজ করেছে। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে।
এ অর্থ সংকট কাটাতে জমা দেয়া গ্যারান্টির টাকা থেকে ঠিকাদারদের অগ্রিম পরিশোধের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সেতু বিভাগের অধীনে প্রকল্পের এলিভেটেড অংশের কাজ করছে জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। এরই মধ্যে আমরা দাতা সংস্থাগুলোর অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের জমা দেয়া গ্যারান্টির টাকা থেকে অগ্রিম পরিশোধ শুরু করেছি। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। তাদের কাজে গতি এসেছে। অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত ঠিকাদার চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডকেও একইভাবে অগ্রিম অর্থ পরিশোধের জন্য দাতা সংস্থাগুলো অনুমতি দিয়েছে। আশা করছি, অর্থ সংকট দ্রুতই কাটিয়ে উঠবে দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ সংকটের বিষয়টি নিয়ে ১৫ মার্চ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে অনুষ্ঠিত এক সভায়ও আলোচনা হয়েছে। সভায় জানানো হয়, ঠিকাদাররা প্রকল্পটিতে পর্যাপ্ত অর্থের সংকুলান করতে পারছে না। প্রকল্পটির অগ্রগতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে বিষয়টি বর্তমানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এডিবির কাছ থেকে অতিরিক্ত ১৮৭ মিলিয়ন ডলার দ্রুত সরবরাহের তাগিদ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট: গাজীপুর-এয়ারপোর্ট বিআরটি’ প্রকল্প। শুরুতে নির্মাণ ব্যয় ছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। ধীরগতির কারণে ব্যয় ও মেয়াদ দুই-ই বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। বর্ধিত মেয়াদের শেষ প্রান্তে চলে এলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। এখনো চার ভাগের এক ভাগ কাজ বাকি।
এ অবস্থায় আরেক দফা প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে একটি সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে আরো দেড় বছর। অর্থাৎ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। সঙ্গে ব্যয় আরো ২৬৮ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা।
ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, অনেকগুলো অনুষঙ্গ নতুন করে যুক্ত হয়েছে। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল বিআরটি প্রকল্পের জন্য ডিজেলচালিত বাস কেনা হবে। এখন বিদ্যুচ্চালিত বাস কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেড়েছে বাসের সংখ্যাও। এর বাইরে বিআরটি কোম্পানির জন্য নিজস্ব ভবন নির্মাণ, বিশেষজ্ঞদের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন করে জমি অধিগ্রহণ, বিদ্যমান সড়ক মেরামতসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে। এ কারণে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। এ সময় আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা বিআরটি কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার সঙ্গে গাজীপুর, টঙ্গী ও উত্তরা এলাকার মধ্যে দ্রুত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। বিআরটির দুদিক থেকে প্রতি ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে সক্ষম হবে। প্রকল্পের আওতায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেডসহ ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিআরটি লেন, ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতু পুনর্র্নিমাণ, সাতটি ফ্লাইওভার, একটি বাস টার্মিনাল, ১১৩টি সংযোগ সড়ক উন্নয়ন, ২৪ কিলোমিটার উচ্চক্ষমতার ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে।-বণিকবার্তা