মহামারী-পরবর্তী অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। আসন্ন এ বাজেটে প্রাধান্য পাচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেয়া হবে ভোক্তার হাতে অর্থপ্রবাহ বাড়ানোয়। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলনে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে এসব বিষয়ই।
অর্থনীতিতে মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে দেশে দেশে নেয়া হয়েছে কৃচ্ছ সাধনের নানা উদ্যোগ। সংকট মোকাবেলায় গত দুই বছরই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বিভিন্ন দেশ। যদিও দেশে সরকারি কর্মীর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও এ খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেতন-ভাতায় সরকারের ব্যয় ছিল ২৮ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আরো বাড়িয়ে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ ব্যয় চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। মহামারীর আগে থেকেই এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে আমদানি যে গতিতে বাড়ছে, রফতানির গতি সে তুলনায় শ্লথ। এর মধ্যে আবার রেমিট্যান্সে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। এতে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আট মাসের ব্যবধানে ৪৮ বিলিয়ন থেকে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে রিজার্ভ। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে ডলার খরচ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাজেটের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা প্রাথমিক বাজেট প্রাক্কলনে সম্মতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমসহ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শামসুল আলম বলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার আলোকে আগামী বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়গুলো সাজানো হয়েছে। আগামী বাজেটে কভিড-১৯ ছাড়াও বিশ্ব মূল্যস্ফীতির প্রভাব কঠোরভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী বাজেটে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে আগামী অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট দিতে চাইছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি দেশের জিডিপির ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে এটি ৭৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এ হিসেবে আগামী অর্থবছর বাজেটের আকার বাড়ছে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। আগামী বাজেটের রূপরেখায় চলতি অর্থবছরের তুলনায় সরকারের পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় বাড়ছে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় এ খাতে ব্যয় ৫৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাড়ছে। সে অনুপাতে বাড়ছে না বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ। এক্ষেত্রে চলতি বছরের তুলনায় বরাদ্দ বাড়ছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ বা ২০ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, চলতি বাজেটে যা রয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। সরকারের দেশী-বিদেশী ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ বাবদ রাখা হচ্ছে ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, চলতি বাজেটে যা রয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি অর্থবছর এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৪৬ হাজার ২০৭ কোটি টাকার এডিপি প্রাক্কলন করছেন। সে অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে এক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ছে ২০ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরে মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে মোট আয় বাড়ছে ১১ শতাংশ। মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এটি জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া আছে। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ১২ শতাংশ বাড়ছে। এছাড়া আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে নন-এনবিআর থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার বেড়ে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা হবে বলে আশা করছে সরকার। সে অনুযায়ী প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ আসবে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ বলে ধারণা করছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও সরকারি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আগামী বাজেট বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কাগজে থাকলেও বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতি বছর দেখা যায় প্রথমে বাজেটের যে আকার ধরা হয় সংশোধিত বাজেটে তা অনেকটা কমানো হয়। তার পরও প্রকৃত ব্যয় সংশোধিত বাজেটের চেয়েও কম হয়। কাজেই বাজেটের যে আকার ধরা হয় সেটা অর্থহীন। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোসহ বেশকিছু প্রণোদনা বাড়ানো ও ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বেতন-ভাতায় বরাদ্দ বাড়ানোটা এড়ানো যেত। তবে সরকার বেশকিছু জনবল নতুন করে নিয়োগ দিয়েছে, আবার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট রয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই বড় ভর্তুকির চাপে পড়তে হয়েছে সরকারকে। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব থাকছে। অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগামী বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাড়তি ভর্তুকির চাহিদা। চলতি বাজেটে শুধু ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে সেটা বেড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাই ভর্তুকি কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আমদানি যে হারে বাড়ছে, রফতানি বাড়ছে সে তুলনায় কম। এতে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ পরিস্থিতিতে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আসন্ন বাজেটের আর্থিক কাঠানো প্রস্তুত করা অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় কষ্টকর। কারণ ব্যয়ের বড় দুটি অংশ যাবে ভর্তুকি প্রণোদনা ও সুদ পরিশোধে। এ দুই খাতে প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্যয় হবে। এর সঙ্গে বেতন-ভাতাসহ সরকারের অন্যান্য পরিচালন ব্যয় যোগ করলে সেটা ৯০ শতাংশের ওপরে চলে যাবে। তাই উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করার জন্য অর্থ খুব কমই থাকবে। এটিই এবারের বাজেটের সব চেয়ে বড় সমস্যা।-বণিকবার্তা