পরোপকার মানে মানবজাতির কল্যাণে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ানো, এগিয়ে আসা, সহমর্মী হওয়া। শুধু নিজের সুখের জন্য নয় বরং অন্যের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করা। এ সবই হচ্ছে সাহায্য বা পরোপকার। আরেকভাবে বললে এভাবে বলা যায়, আমাদের সমাজের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি ও অপকর্ম বন্ধ ও সমাধানের নিয়তে কাজ করার চেষ্টা করাই হলো পরোপকার।
এই পরোপকারই মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের অলঙ্কার। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে বলেছেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে।’(সূরা আলে ইমরান-১১০) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও। তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’ (তিরমিজি)।
মানুষের উত্তম গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই পরোপকার। মানুষের জন্য একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া একা জীবন-যাপন করা খুবই কঠিন। যখন কোনো সমাজে একে অপরের প্রতি সহযোগিতার মন-মানসিকতা হ্রাস পায়; তখন সে সমাজের মানুষ সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়ে। সে সমাজের সর্বক্ষেত্রে অভাবের কারণে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, শান্তি বিলুপ্ত হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা দূর হয়ে যায়। ইসলাম একটি সহানুভূতির ধর্ম। যেখানে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা অন্যতম বিষয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাই পরোপকারের চেতনার ক্ষেত্রে কোনো শ্রেণিভেদ নেই।’ বড়-ছোট, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, স্বজাতি-বিজাতি, মুসলিম-অমুসলিম এসব ব্যবধানের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলাম শান্তি ও সৌহার্দ্যরে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। তার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল-মুজামুল আওসাত)
পরোপকার বা অন্যকে সাহায্য করলে নিজেরই কল্যাণ হয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘অবশ্যই দান-সদকা মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে। অপমৃত্যু থেকে বাঁচায় এবং অহমিকা দূর করে।’ (আল-মুজামুল কাবির-১৩৫০৮) অনাথ-অসহায় ও অনাহারির কষ্টে সমব্যথী হতে আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের রোজা ফরজ করেছেন। নিঃস্ব ও অভাবীর অভাব মোচনে জাকাত ফরজ ও সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। দান-সাদকা ও অন্যের জন্য খরচে উদ্বুদ্ধ করে অনেক আয়াত নাজিল করেছেন। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘কে আছে যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা উত্তম ঋণ দেবে, তাহলে তিনি তার জন্য একে বর্ধিত করে দেবেন এবং তার জন্য সম্মানজনক প্রতিদানও রয়েছে।’(সূরা হাদিদ-১১) এক হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার আখিরাতের সঙ্কটগুলোর একটি সমাধান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-গুণ গোপন করবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষও গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে। (মুসলিম)
তাই আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গার ফসলাদি, ঘরবাড়ি ও শহর বর্ষার (বিশেষ সিলেটের বিভিন্ন গ্রাম ও শহর) পানিতে এখন প্লাবিত, সমাজের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ সবাই এখন কঠিন সময় পার করছে। দেশের, সমাজের এসব দরিদ্র ও অসহায় মানুষের কষ্ট যাতে কিছুটা হলেও লাঘব হয় সে জন্য খাবার-দাবার, কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটু সাহায্য করাও একটি পরোপকার। যা শুধু সরকার নয়, সমাজের বিত্তবান শ্রেণী ও সাধারণ মানুষের জন্যও অংশগ্রহণ করা জরুরি। সমাজ, দেশ ও মানবতার কল্যাণে কাজ করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পরোপকার। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ফরজ বিধানগুলো আদায়ের পাশাপাশি সমাজ, দেশ ও গরিব অসহায় মানুষের কল্যাণে অর্থাৎ অন্য মুমিন মুসলমানের কল্যাণে বা পরোপকারে কাজ করা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব। লেখক : শিক্ষার্থী, দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা, টাঙ্গাইল।