বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে নাশকতা বা ধ্বংসাত্মক কর্মকা- ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচন করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে আজ গণভবণে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সারা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বড় সাফল্য। সেতুটি নির্মাণের শুরু থেকেই সরকারবিরোধীরা ষড়যন্ত্র করছে। তারা দেশে-বিদেশে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে, ষড়যন্ত্র করছে। সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরেও নাশকতার অপচেষ্টা চলছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান গণমাধ্যমকে বলেন, সেতুকে ঘিরে দেশের বাইরে থেকেও উসকানি দেয়া হচ্ছে। দেশের ভেতরেও কেউ কেউ এ ধরনের কাজ করতে পারে। আমরা তাদের মনিটরিং করছি। সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সারা দেশেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, যেসব জায়গায় বড় পর্দায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানো হবে সেসব জায়গায় নজদারি বাড়ানো হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা অনুষ্ঠানস্থলে আসবেন তাদের চলাফেরা নির্বিঘœ করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
ডিআইজি আরও বলেন, কেউ নাশকতার পরিকল্পনা করে থাকলে সেটা সফল হবে না। ষড়যন্ত্রকারীদের আমরা ইতোমধ্যে নজরদারিতে এনেছি। আইনশৃঙ্খলার অবনতি যাতে না হয়, সেজন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত সবই আমরা নিয়েছি। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করছে।
ড. মো. আকরাম হোসেন পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন,‘ যমুনার ওপরে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু, গড়াই নদীতে লালন শাহ সেতু, মেঘনায় রয়েছে বাংলাদেশ-জাপান মৈত্রী সেতু-১, ব্রহ্মপুত্র ও বুড়িগঙ্গায় আছে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল প্রমত্ত পদ্মার বুকে একটি কাঙ্ক্ষিত সেতু। যা বর্তমান সরকারের ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে আজ কোটি কোটি মানুষের সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে দৃশ্যমান। ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে বাংলাদেশ। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের বৃহদাকার সেতুটি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরকে। নির্মাণাধীন এই সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মিলন ঘটেছে। .. বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ অবশ্যই দেশের জন্য এক অকল্পনীয় ঘটনাই বটে! যদিও পদ্মা সেতু বাংলাদেশের একমাত্র মেগা প্রকল্প নয়, এর আগেও এদেশে বহু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুর বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কেননা এই সেতু নির্মাণ নিয়ে ঘটে গেছে অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনা; কেউ কেউ মেতে উঠেছিল গভীর ষড়যন্ত্রে। কিন্তু সকল চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান হয়েছে; বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এই সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেনি। এটি আমাদের আত্মগৌরবের জায়গাটিকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। যে দেশে সত্তরের দশকেও শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করত, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থা ছিল তলাবিহীন ঝুড়ির মতো, সেই দেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এবং এর সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে, এই গৌরববোধ ও আভিজাত্যের অনন্য অহংকার। .. এক সময় বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বিশ্বব্যাংক বা দাতা দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। মনে করা হতো, বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া এ দেশ কোনো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কিন্তু এখন বাংলাদেশ তার আত্মবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করেছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা বহুমুখী সেতু। যেখানে সড়ক ও রেল উভয় মাধ্যমেই সংযোগ স্থাপিত হবে এবং এর মাধ্যমে দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর বিল্গব সাধিত হবে। পদ্মা সেতুর নানান অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকেই এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল ও অধিকতর চাঙ্গা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। এই সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ ও পণ্য পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিদৃষ্ট হবে। পদ্মা সেতু ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগসূত্র স্থাপন করবে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী নয়। অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পেছনেই পড়ে আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকেু বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে। তাই আমরা বলতে পারি, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে যেমন ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে কৃষকরা আরও অধিক হারে উৎপাদন করবেন। পাশাপাশি এ সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সচল রাখবে। দক্ষিণাঞ্চলে অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যা ভ্রমণপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে থাকে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার অনুপযোগিতার কারণে মানুষের কাছে অনাগ্রহের বিষয় ছিল। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এখন তা নাগালের মধ্যে চলে আসবে। এসব পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে তা থেকেও রাষ্ট্র প্রচুর অর্থ আয় করতে সমর্থ হবে। নানা দিক বিবেচনায় আমরা নিঃসংকোচে বলতে পারি, স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের অনাগত স্বপ্ন পূরণে সারথির কাজ করবে। এ দেশ নিজের অর্থায়নে এত বিশাল সেতু নির্মাণ করতে পারলে, ধীরে ধীরে আরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিজ অর্থেই সম্পন্ন করতে পারবে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জাতীয় মনোবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’