কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দিনভর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পাল্টে যায় রাতে ফলাফল ঘোষণার সময়। জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্রে তখন দুপক্ষের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। ফলাফল ঘোষণা বন্ধ থাকে প্রায় এক ঘণ্টা। এসময় দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরীকে কয়েকদফা ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব ও কয়েকদফা ফোনে কথা বলাসহ নির্বাচন নিয়ে উঠা নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। আজ দুপুরে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রিটার্নিং অফিসার। প্রায় এক ঘণ্টা ফলাফল ঘোষণা কেন স্থগিত ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটার পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল না। পরিস্থিতি প্রতিকূলে ছিল বিধায় সময় লেগেছে। দুই পক্ষই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।’ ওই সময় বারবার কার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, ‘তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি ফোনে কথা বলছিলাম সিইসি, ডিসি ও এসপির সঙ্গে। অন্য কারোর ফোন আসেনি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পরাজিত প্রার্থী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তবে নতুন করে ফলাফল দেওয়া সম্ভব নয়। ফল ঘোষণার সময় তারা কেন অভিযোগ জানাননি। কারণ তাদের হাতে তো রেজাল্ট শিট ছিল।’
বুধবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে দিনভর শান্ত পরিবেশে ভোটের পর রাতে ফল ঘোষণা কেন্দ্রে তুমুল উত্তেজনা হয়। এর মধ্যেই মেয়র পদে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। বেসরকারি ফলাফলে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর চাইতে ৩৪৩ ভোট বেশি পান নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। রাত সাড়ে ৯টার দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেন। তবে তার আগে হইচইয়ের মধ্যে কারচুপির সন্দেহের কথা বলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাক্কু।
রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত ফল অনুযায়ী, ১০৫ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। বিদায়ী মেয়র সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। তৃতীয় স্থানে থাকা নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট।
ফল ঘোষণার পরপরই সাক্কু তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, নির্বাচনে আমি জয়ী হওয়ার পরই আওয়ামী লীগের লোকজন রিটার্নিং অফিসারকে চাপ দেন। এ কারণে কিছু সময়ের জন্য ফল বন্ধ রাখা হয়। পরে ফল পাল্টে দিয়ে রিফাতকে জয়ী করা হয়েছে। আমাকে সুপরিকল্পিতভাবে হারানো হয়েছে। তা না হলে নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে ফল বন্ধ রাখল কেন? এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নেব।
আউয়াল কমিশনের প্রথম পরীক্ষা কেমন হলো:
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রদীপ সরকার ‘ আউয়াল কমিশনের প্রথম পরীক্ষা কেমন হলো’ শিরোনামে লিখেছেন,‘কে এম নূরুল হুদা কমিশন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম পরীক্ষা ছিল ওই বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন (কুসিক)। সেই কুসিক নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু করা ছিল নূরুল হুদা কমিশনের জন্য অন্তত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার আগে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কমিশন ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি যে অনাস্থা তৈরি করেছিল, তা কাটিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার চ্যালেঞ্জ ছিল নূরুল হুদা কমিশনের সামনে। কুসিক নির্বাচনে নূরুল হুদা কমিশন সেই চ্যালেঞ্জ অনেকটাই সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছিল। সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কমই প্রশ্ন উঠেছিল।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনেরও প্রথম পরীক্ষা ছিল গত বুধবারের কুসিক নির্বাচন। সারাদিনের ভোটে অল্পবিস্তর অভিযোগ থাকলেও গুরুতর কোনো অভিযোগ ছিল না। তাই গতকাল বিকেলে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত পরপর দুই দুবার কুসিকের সাবেক মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক বলেছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ফলাফলে জয়-পরাজয় যাই হোক তিনি মেনে নেবেন।
তবে পরিস্থিতি শেষ পর্যায়ে এসে আর তেমন ছিল না। গোল বাধে ফলাফল ঘোষণার শেষ পর্যায়ে এসে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করে বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের চেয়ে ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক কুসিক নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।
তবে মনিরুল হকের দাবি, নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। তাঁর ফল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। নগরবাসী তাঁকে ভোট দিয়েছেন। নগরবাসীর জন্যই তিনি দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করেছেন, দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তিনি এ ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন।
একই সঙ্গে কুসিক নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় আওয়ামী লীগের কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসি। সেই বাহাউদ্দিনকে নির্বাচনি এলাকা ছাড়েননি। বরং তিনি ইসির চিঠি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ভোট শেষে গতকাল কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলতে চান না। অন্যদিকে ভোট শেষে বাহাউদ্দিনের বাসায় গেছেন বেসরকারিভাবে জয়লাভ করা আরফানুল হক। সেখানেই তিনি জয় উদ্যাপন করেছেন। বিষয়টি কিছুটা হলেও ইঙ্গিত দেয়, বাহাউদ্দিনের কুসিক নির্বাচনে প্রভাব ছিল।
ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্যের হাত থেকে ভোটকে পুরোপুরি প্রভাব মুক্ত করতে পারেনি কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। ফলে জাতীয় নির্বাচনে এই কমিশন কীভাবে ৩০০ সংসদ সদস্যের হাত থেকে ভোটকে প্রভাবমুক্ত রাখবে, সেই প্রশ্ন রয়ে গেল। কুসিক নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোগান্তি ছিল। গোপন কক্ষে উঁকি দেওয়ার অভিযোগও আছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় দিন শেষে ভোট নিয়ে বড় ধরনের অসন্তোষ ছিল না।’