বাড়ছে পানির স্রোত, ভয়াবহ পরিস্থিতিতে লাখ লাখ মানুষ
ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টিতে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্ধার তৎপরতায় সহযোগিতা ও মানবিক কার্যক্রমে অংশ নিতে এবার নামছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ডুবুরিদল। এছাড়া উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ও কোস্ট গার্ডের দুটি ক্রুজ। এরই মধ্যে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল সিলেটে পৌঁছে কাজ শুরু করেছে। সিলেটের জেলা প্রশাসনের মুখপাত্র ও সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, নৌবাহিনীর টিম চলে এসেছে। ৩৫ জনের একটি ডুবুরিদল কাজও শুরু করেছে। বিকেলে ৬০ জনের আরেকটি বড় দল আসবে। কোস্ট গার্ডের দুটি ক্রুজ দুপুরের পর আসবে। একটি সুনামগঞ্জ যাবে। আরেকটি সিলেটে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হবে। এছাড়া বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
এর আগে শুক্রবার (১৭ জুন) সেনাবাহিনীর ৯টি ইউনিট সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলায় উদ্ধার কাজ চালায়। এদিকে, বন্যার ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে এমন আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখনো প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। আক্রান্ত মানুষের এখন প্রাণে বাঁচার আর্তনাদ। অনেকে গবাদি পশু রেখে প্লাবিত এলাকা ছাড়ছেন না। কিন্তু বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে মানুষের প্রাণ সংহার হতে পারে। আক্রান্ত বেশিরভাগ এলাকায় এখন শুকনো মাটিও নেই। এ অবস্থায় পানিবন্দি লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শনিবার (১৮ জুন) থেকে উদ্ধার কাজে নৌবাহিনীও যুক্ত হলো।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, নৌবাহিনীর সদস্যরা শনিবার সকালে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের সালুটিকরে অবস্থান নেন। এরপর সেখান থেকে উপদ্রুত এলাকায় গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেছেন।
এরআগে জেলা প্রশাসকের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে শুক্রবার দুপুর থেকে সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের ৯টি টিম সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৮টি উপজেলায় কাজ শুরু করে। ‘রেসকিউ বোট’ দিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন।
১৭ পদাতিক ডিভিশন ও সিলেট এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল হামিদুল হক এনএসডব্লিউসি, পিএসসি গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিলেটের ৩ উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় সেনাবাহিনী পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারসহ পাঁচটি কাজে তৎপরতা শুরু করেছে।
সিলেটের উপজেলাগুলো হচ্ছে সদর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ জেলার সদর, দিরাই, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ।
তিনি বলেন, সিলেট কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্যার পানি উঠে বিদ্যুৎ সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি খাদ্য গুদাম ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো রক্ষায়ও সেনা সদস্যরা কাজ করছেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বন্যা কবলিত এলাকায় পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করা হচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পানিবন্দি মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বন্যা আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ও স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সীমিত পরিসরে খাদ্য সামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জিওসি বলেন, সেনাবাহিনী নিজস্ব নৌকা দিয়ে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করছে। ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে আরও ‘রেসকিউ বোট’ আনা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় লোকজনের নৌকাগুলোও উদ্ধার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের কাজ করতে পারাকে সেনাবাহিনীর গৌরব বলে জানান তিনি।
বাড়ছে পানির স্রোত, ভয়াবহ পরিস্থিতিতে লাখ লাখ মানুষ: দেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভারী বর্ষণ ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে সিলেট-সুনামগঞ্জের পর এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শেরপুর ও নেত্রকোনায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। জনজীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি। এদিকে পানির করাল স্রোতে পানিবন্দি মানুষেরা অসহায়ত্বের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করছেন। ভেঙে যাচ্ছে কাঁচা ঘর-বাড়ি। পানির ওপর ভাসছেন মানুষ, ভাসছে প্রাণী। সীমাহীন দুর্ভোগে থাকা মানুষের পাশাপাশি কষ্ট বেড়েছে গৃহপালিত গবাদি পশুরও। যে যেভাবে পারছেন, গরু-ছাগলগুলোকে উঁচু জায়গাতে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
এদিকে সিলেটে অপ্রতিরোধ হয়ে ওঠা বন্যায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের সাথে বিচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগ। সিলেটের পুরাতন রেল স্টেশন ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা এখন পানির নিচে। মানবিক সংকটের এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের বন্যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ভারত থেকে আসা ঢলে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ উজানে আগামী দুই দিন ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।
জানা গেছে, বন্যা পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর অবনতি হওয়ায় দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। অধিকাংশ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। টেলিফোন নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে। বিদ্যুৎবিহীন রয়েছেন সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৩ লাখ মানুষ। অর্ধাহারে-অনাহারে পানির সাথে যুদ্ধ করছেন সিলেট-সুনামগঞ্জের অন্তত ২০ লাখ মানুষ। খাদ্য সংকটের পাশাপশি রয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে জিও ব্যাগ ফেলে সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুতের গ্রিড উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশ ঠেকাতে কাজ করছেন। তাদের সাথে সিলেট সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা কাজ করছেন। এছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দ্রুত বাড়ছে। এরই মধ্যে তিস্তা অববাহিকার চারটি জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে পারে বলে মনে করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।