শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ অপরাহ্ন

ভয়াবহ চার বন্যার প্রত্যক্ষদর্শী

জয়নুল আবেদীন
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০২২

মেঘনা ও এর শাখা-প্রশাখাবেষ্টিত একটি দ্বীপ। দেশের মূল ভূখ- থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে আমার জন্ম। সরকারের সুযোগ-সুবিধার বাইরে থাকলেও ছিলাম প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতির কোলে মাছে-ভাতে বেড়ে ওঠাসহ ভাঙা-গড়া, ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা ছিল নিত্যসঙ্গী। ল-ভ- করা বন্যার পরও বর্ষাই প্রিয় ঋতু। শীত-গ্রীষ্মের যন্ত্রণা থেকে মুক্তিসহ মাছ ধরার জন্য ছিপ-বড়শি নিয়ে বর্ষার প্রতীক্ষায় থাকতাম। শৈশব থেকেই বর্ষার রূপ ও বীভৎস মূর্তির প্রত্যক্ষদর্শী। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জল বন্যা ছাড়া টের পাওয়া যায় না। শৈশবে টের পেয়েছিলাম আমিও। বড় বোনের যখন বিয়ে তখন আমার বয়স দুই বা তিন বছর। বিয়ের তারিখ হয়েছিল কুদিন (ক্রমাগত বৃষ্টি) শুরুর আগে। আমাদের বাড়ি চর এলাকায় আর বরের বাড়ি পুরান অঞ্চলে। চর এলাকা থেকে পুরান অঞ্চল সামান্য উঁচু। বিয়ের পর আড়াই দিন আড়াইউল্লা করার কথা থাকলেও ভিটিতে পানি উঠে পড়ার আশঙ্কায় বরযাত্রী চলে গিয়েছিল। অপরাপর বিষয় মনে না থাকলেও বরযাত্রী চলে যাওয়াসহ উঠানে নৌকা রাখার দৃশ্য সুস্পষ্ট মনে আছে। মাঠে ধানের চারা শক্ত হওয়ার আগেই শুরু হয় কুদিন। দেখতে দেখতে নদী ফুলে খাল-বিল ভরে ওঠে পানিতে। উঠানে চলে আসে পানি। পুরুষানুক্রমে প্রধান পেশা কৃষি হলেও তৎসঙ্গে বাবা সিলেটে ধানের ব্যবসাও করতেন। বাবার ছিল ৪০০ মণ মালবাহী নৌকা। নৌকা নিয়ে আসেন উঠানে। তলিয়ে যায় মাঠের ধান। দেখতে দেখতে পানি উঠে যায় ঘরের ভিটির উপর। ঘরে একটা মাত্র চৌকি (কাঠের নির্মিত শয়নের স্থান)। রান্না-বান্নাসহ আমরা নৌকায় আশ্রয় নিই। বাবা-চাচাসহ আমাদের তিন ভিটিতে তিন ঘর। কাছাকাছি বয়সের আমরা চার কাজিন। বাঁশের সাঁকো দিয়ে একঘর থেকে আরেক ঘরে চলাচল। সবার মন বিষণ্ণ থাকলেও আমরা ছিলাম ফুরফুরে। উঠানের পানিতে গোসল আর বাঁশের সাঁকো ধরে এ ঘরে ও ঘরে যাতায়াত মজা আর মজা। চৌকির পাশে মাছ নড়াচড়াসহ সাপ সাঁতার কাটত। যাদের নৌকা নেই তারা ঘরে বাঁশের মাচায় আশ্রয়সহ কলাগাছের ভেলায় চড়ে চলাচল করত। রান্না করতে গিয়ে মা খুব কষ্ট করতেন। দু’-চারটি পাট ক্ষেত ছাড়া মাঠে আর কোনো ফসল ছিল না। তিন প্রকার ধানের মধ্যে আমন ধান অন্যতম। আমন ধান নষ্ট হয়ে পড়ায় অনিবার্য অভাবের কথা ভেবেই মানুষ দিশেহারা। বন্যা ও বর্ষা শেষে মাঠ জাগে। খালি মাঠে মাসকলাই বপন করা হয়। শুরু হয় অকাল। মহামারী আকারে দেখা দেয় কলেরা। সে বছর প্রচুর মাসকলাই এবং মিষ্টি আলু হয়েছিল। মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে, চুলায় পুড়ে কিংবা বিস্কুটের মতো কেটে ফ্রাই করে নানা প্রকারে খাওয়াসহ কুচিকুচি করে কেটে চালের সাথে মিলিয়ে ভাত রান্না করতে দেখতাম। অনেকেই এক ভাগ চাল, এক ভাগ মাসকলাই ও এক ভাগ মিষ্টি আলু মিলিয়ে ভাত রান্না করতেন। মাসকলাইয়ের ভাতসহ লবণ দিয়ে কাঁচা লাউ খেতেও দেখেছি। সে সময়ের অভাবের কথা বলতে গিয়ে মা প্রায়ই একটা কথা বলতেন, মাকে একদিন বড় পাতিলে রান্না চড়াতে দেখে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘মা, আজকেই অভাব শেষ?’ পুরোনো নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে যতদূর জানতে পারি, এই বন্যাটি হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। ৫০ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার প্লাবিত হয়ে দেশের ৩৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে জাতিসঙ্ঘের কারিগরি সহায়তায় বন্যা সমীক্ষার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে বন্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ, প্রকৃতি নির্ণয়, বিশ্লেষণ এবং নিয়ন্ত্রণের পথ ও পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য তিনজন পানি বিশেষজ্ঞসহ উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিল। বন্যার পর ১৯৫৭ সালে জাতিসঙ্ঘের অধীনে গঠিত, ক্রুগ মিশনের সুপারিশক্রমে এতদঞ্চলের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) গঠন করেন। ইপিওয়াপদার ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা -২০০৪ প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যাকালে আমি সোনারগাঁ।
ঢাকাসহ নিজ উপজেলা ছেড়ে সবেমাত্র সোনারগাঁ। উপজেলা কোর্টের পেছনে মোল্লা বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সপরিবার উঠেছি। আইন পেশার মরাকটাল কাটিয়ে জোয়ারের শুরুতেই শুরু হয় বন্যা। ছোট মেয়ে মল্লিøকা এক পা দু’পা করে হাঁটতে শুরু করেছে। টুক টুক করে এ ঘরে ও ঘরে যায়। উঠানে পানি উঠতে শুরু করলে হাঁটার জন্য ইট বিছিয়ে দিই। দেখতে দেখতে তলিয়ে যায় হাঁটা চলার ইট। পুরান ঢাকায় সালমার এক আত্মীয় গ্রেফতারের সংবাদ শুনে সালমাকে নিয়ে ঢাকা যাই। যে রাস্তায় ঢাকা গিয়েছি পরদিন সে রাস্তায় ফিরতে গিয়ে কাঁচপুর এসেই আটকে পড়ি। বাস বন্ধ। রাস্তা কোথাও কোথাও তলিয়ে গেছে। বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশা করে পানি পার হতে হয়। পানি বাড়ছে হুহু করে। এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে রিকশাও তলিয়ে যেতে শুরু করে। ছোট ছোট নৌকা নেমেছে রাস্তায়। রিকশা নৌকা অদল-বদল করে সাত-আট ঘণ্টায় সোনারগাঁ আসি। ভাড়া বাসার ঘরের ভিটার উপর পানি উঠে যায়। বাসায় কাছেই উপজেলা আদালত। আদালতের ফ্লোর বাদে চারদিকে থই থই পানি। বিজ্ঞ বিচারকসহ আমরা ছোট নৌকায় করে কোর্টে গেলেও লোকজন আসা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় আদালতও। ভাড়াবাসা তালা দিয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে যাই। মাছ ধরার নেশা ছিল শৈশব থেকেই। দূরে যেতে হতো না। ঘরে বসেই উঠান থেকে টেঁটা দিয়ে মাছ ধরতাম। রাতে এক হাতে টর্চ আরেক হাতে টেঁটা। এক-দেড় ঘণ্টায় জোগাড় হয়ে যেত রান্নার মাছ।
সরকারি তথ্যমতে, ‘১৯৮৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংঘটিত এই বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। বেশ কয়েকটি স্থানে এই বন্যা ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হয়। এটি ছিল এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষয়ক্ষতিময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশ্বের গণমাধ্যমসহ দুর্যোগটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বন্যার মূল কারণ ছিল সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হওয়া। এই বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পরে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বন্যার কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের জন্য নেয়া হয়েছিল ২৬টি বন্যা কর্মপরিকল্পনা (ফ্যাপ)। ফ্যাপ ১৯-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পানি খাতে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণের জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে ‘ইজিআইএস প্রকল্প’-এ পরিণত হয় এবং নেদারল্যান্ড সরকারের কারিগরি সহায়তায় ২০০২ সালে ‘সিইজিআইএস’ ট্রাস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯৮ সালের বন্যায় আমরা সোনারগাঁয়ের নতুন বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ বাড়ি থেকে আরামে ওকালতি করার আশায় বাড়ি করেছিলাম। উপজেলা কোর্ট থেকে বাড়ি পাঁচ মিনিটের পথ। বাড়িতে গাছ-গাছালি লাগানোসহ ফাউন্ডেশনসহ এক তলার কাজ শেষ করতেই আদালত সদরে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৯৩ সালের শেষদিকে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে কোর্ট চলে যায় জেলা সদরে। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর অনেকে মনে করেছিল, কোর্ট আবার চলে আসবে। তাই একজন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনজীবীরা বাসাবাড়ি বদলাননি। নতুন সরকার উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ দ্বারা আংশিক উপজেলা পদ্ধতি পুনরায় চালু করলেও কোর্ট-কাচারি সদরেই রয়ে যায়। আমরা বিজ্ঞ বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী সোনারগাঁ থেকে নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়া করতাম। মোগড়াপাড়া থেকে বাসযোগে চিটাগাং রোড় হয়ে কিংবা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডে দুই নদী ত্রিবেনী ও শীতলক্ষ্যা পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়া রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের আগস্টের প্রথমদিকেই ব্রিজ কালভার্ট ছাড়া গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড পানিতে ডুবে যায়। বড় রাস্তায় বাসসহ রিকশা-স্কুটার বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিজ-কালভার্টে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে জলমগ্ন মানুষ আর গবাদিপশু। কোর্ট বন্ধ হয় না। বাড়ি থেকে ডিঙ্গি করে প্রথমে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের উদ্ধবগঞ্জ ব্রিজ, ব্রিজ থেকে ট্রলারযোগে কাইকারটেক বাজার, বাজার থেকে আরেক ট্রলারযোগে নবীগঞ্জ রেললাইন, রেললাইন থেকে নারায়ণগঞ্জ চারার গোপ, চারার গোপ থেকে রিকশায় করে বার লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতাম। দেখতে দেখতে পানি প্রবেশ করে নারায়ণগঞ্জ শহরসহ আদালতপাড়ায়ও। এক কোর্ট থেকে আরেক কোর্টে ডিঙ্গি ছাড়া চলাচল বন্ধ। কোর্টে আসা-যাওয়ার পথ পুলসিরাতের পথের চেয়েও কষ্টকর। সারা সপ্তাহ ছুটির দিনের অপেক্ষায় থাকতাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার সমুদ্রে সাইক্লোন কাহিনীতে ভয়ঙ্করেরও যে একটা রূপ আছে তার বর্ণনা দিয়েছেন। ভয়ঙ্করের রূপ দেখার জন্য নিয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি। ছুটির দিন বাড়ির ছাদে বসে বন্যার সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখতাম। রাতে টর্চ আর টেঁটা নিয়ে আশপাশ থেকে শিং, বাইলা, টেংরা, টাকি ইত্যাদি মাছ ধরতাম। বাড়ির উত্তরদিকে ডেউয়া গাছের গোড়ায় এক হাঁটু পানি। পানিতে আলোড়ন শুনে ছাদের উপর থেকে তাকিয়ে দেখি, বিশাল এক গজার মাছ। মাছ দেখলেই ধরার লোভ জাগত। কৌশলে ধরেছিলাম গজার মাছটিও। এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, পানি কমছে না মাস শেষেও। এই অবস্থায় কোর্টে আসতে মন চাইত না, বিকেলে মন চাইত না বাসায় ফিরতে। আদালতে মক্কেল হাজির না হলেও আইনজীবীদের হাজির হতে হয়। আইনজীবীদের হাজির হতে হয় গরহাজির আসামিদের পক্ষে সময় চাওয়ার জন্য। ব্যর্থতায় বিনা তদবিরে গরহাজিরার কারণে গ্রেফতারি পরোয়ানার সমূহ সম্ভাবনা।
আমার এক মক্কেল কুমিল্লা থেকে আসতেন। নাম সোনা মিয়া। অপহরণসহ খুনের মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি। অশীতিপর সোনামিয়া হাজিরার আগের দিন আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন। পরদিন হাজিরা দিয়ে বাড়ি যেতেন। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ হয়ে পড়ায় এক হাজিরায় সোনা মিয়া আসতে পারেনি। ডিঙ্গি করে এক আদালত থেকে আরেক আদালতে গিয়ে সময়মতো সময়ের দরখাস্ত দেয়াও সম্ভব হয়নি। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার কথা শুনে সোনামিয়া ভয়ে আর আদালতেই হাজির হয়নি। অনুপস্থিতিতে সোনামিয়ার সাজা হয়। সাজা হওয়ার কথা শোনার পর কী করেছিলেন, জানি না। বছর পাঁচেক পর ওই এলাকার এক লোকের কাছে জানতে পারি, সোনা মিয়া নেই। সরকারি পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়ঙ্কর বন্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই মাসের অধিককালজুড়ে সংঘটিত ওই বন্যায় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যায়। এই ভয়ঙ্কর বন্যাটি সংঘটিত হওয়ার মূল কারণ ছিল সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (মাত্র তিন দিনে) দেশের প্রধান তিনটি নদীর পানি প্রবাহ একই সময়ে ঘটায় ও ব্যাক ওয়াটার ই্যাফেক্টের কারণে নদীর বহন ক্ষমতার আিতরিক্ত পানি প্রবাহিত হয়। তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া ১৯৯৮ সালের বন্যা সম্পর্কিত বর্ণনা। ২০২২ সালের বন্যা চলমান। এখন পত্র-পত্রিকাসহ টিভি খুললেই চোখে পড়ে, বন্যার ভয়াল ছবি। কোথাও টিনের ঘরের চালের টুয়ায় টুয়ায় পানি, মানুষের সাড়াশব্দ নেই। মানুষ আগেই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে। মাথায় বস্তা, কাঁধে শিশু, পাশে বৃদ্ধা বুক পরিমাণ পানি ভেঙে ছুটছে আশ্রয়ের সন্ধানে। হাস-মুরগি, ছাগল ও শিশুসহ কানায় কানায় বোঝাই ডিঙি, স্বামী-স্ত্রী ঠেলে নিয়ে চলছেন অজানার সন্ধানে।
অপর এক খবরে প্রকাশ, ‘গত ২০ জুন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা সদরে বানভাসি মানুষের জন্য দুপুর ১২টায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হচ্ছিল ত্রাণসামগ্রী। অসহায় ও বুভুক্ষু মানুষগুলো সেগুলোই গ্রহণ করার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। এ সময় ঘাড়ে, মাথায় বস্তা পড়ে এবং ধাক্কাধাক্কিতে ১০ জন আহত হন। তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সোহেল রানা বলেন, বন্যার পানির জন্য সদরের কোনো স্থানে নামতে না পারায় আকাশ থেকেই তারা ত্রাণের বস্তা মাটির দিকে নিক্ষেপ করেছিল। ত্রাণ গ্রহণ করতে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন।’ টিভি খুললেই দেখা যায় বানভাসি ক্ষুধার্ত নারী-পুরুষ ত্রাণের সন্ধানে কোমর ও হাঁটু জল ভেঙে দিগি¦দিক ছুটাছুটি করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা। পার্থ শঙ্কর সাহার নেয়া সাক্ষাতকারের সারাংশ থেকেই ২০২২ সালের বন্যার কারণ ও ঐতিহাসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বক্তব্যের সারাংশে ‘মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা এ যাবতকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে এখানে ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন ১,৫৬৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার, এরও আগে ১৯৫৬ সালের ৫ জুন ৯৭৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। গত ১৭ জুন হওয়া বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৯৭২ মিলিমিটার। ১২ জুন থেকে ১৮ জুন এক সপ্তাহে মোট বৃষ্টির পরিমাণ তিন হাজার ৩০০ মিলিমিটার। এ বৃষ্টির পানি যাবে কোথায়? যদি তিন দিন বিরতি পাওয়া যায়, তবে এ পানি নেমে চলে যেত। হিসাব মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক ঝড় বৃষ্টি। ঐতিহাসিক বৃষ্টিপাত সম্পর্কে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভূমিকা আছে এখানে। গ্রিন হাউজ গ্যাস বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে তাপমাত্রা, বেশি জলীয়বাষ্প তৈরি হচ্ছে। এদিকে আবার প্রশান্ত মহাসাগরে ‘লা নিনা’ অবস্থা বিরাজ করছে। এতে প্রচুর বৃষ্টি হয়। গত দুই বছর ধরে লা নিনা অবস্থা বিরাজ করছে।’ একমাত্র প্রতিকার বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানো। ভূপৃষ্ঠের বার্ষিক গড় তাপমাত্রার তারতম্য চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া, অতরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারী বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ১০ জেলার ৬৪ উপজেলা বন্যা কবলিত বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি বলেন, বন্যা কবলিত এলাকার মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। বলা হচ্ছে, ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। সর্বশেষ ২০ জুনের খবর থেকে জানা যায়, বিমান বন্দরের রানওয়েতে পানি ওঠায় বন্ধ হয়ে গেছে সিলেটের বিমান চলাচল, সুনামগঞ্জের পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সিলেটের বিদ্যুৎও। লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com