গতকাল ১৪ জুলাই, মহান স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান সিরাজের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমা সদরে সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া শাজাহান সিরাজ ষাটের দশকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি করটিয়া সা’দত কলেজে দুই বার ভিপি নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এসে ’৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৮-র আগরতলা মামলাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এরপর উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে তিনি অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে যে চার জনকে ‘চার খলিফা’ বলা হতো, তাদের একজন হলেন শাজাহান সিরাজ। ’৭০-এ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রচার, ’৭১-এর ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের শুরুতে ৩ মার্চ ছাত্রসমাজের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন শাজাহান সিরাজ। এ সময় মুহুর্মুহু করতালি আর জনতার স্লোগানে মুখর হয়ে গিয়েছিল পল্টন ময়দান। এর আগে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবন চত্বরে ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলা পতাকার উত্তোলনের সময় আ স ম আবদুর রবের সহযোদ্ধা ছিলেন শাজাহান সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুজিববাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ ছাত্রনেতার পাশাপাশি শাজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তার এলাকা টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। উপজেলা সদরে কালিহাতী শাজাহান সিরাজ কলেজটিও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। পাবলিক পরীক্ষায় নকলবিরোধী আন্দোলনে তিনি সব সময় ছিলেন সোচ্চার। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার গুণমানের উন্নয়ন ছাড়া দেশের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
মানুষের অধিকার আদায় ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করা— এই নেতা রাজনীতিতেও ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি তার জনপদে রাজনীতি করতেন পায়ে হেঁটে। কথা ও কাজে কোনো তফাত না করা এই রাজনীতিক সব সময় ভাবতেন মানুষের কল্যাণের জন্য এবং এটিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। যদি কখনো কেউ কথা প্রসঙ্গে পরিবার ও সন্তানদের সম্পর্কে কিছু জিগ্যেস করতেন, তিনি তাতে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যেতেন। না! অন্য কোনো কারণে নয়! মানুষকে নিয়ে এত নিমগ্ন থাকতেন যে, পরিবারের কথা প্রায়শই ভুলে যেতেন। তখন তিনি পরিবারের কেউ কাছে থাকলে বা ফোনে বাসা থেকে জিগ্যেস করে জানতে চাইতেন নিজের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোন ক্লাসে পড়ে!
তার কথা বলার ধরন খুব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করত। তার বড় গুণ ছিল মানুষের মতামতকে সম্মান করা। তিনি সব সময় যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন ও অন্যের যুক্তিও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কারো মত গ্রহণযোগ্য হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা গ্রহণ করতেন। পাঁচ বারের সাবেক এই সাংসদ ও মন্ত্রীকে স্যার সম্বোধনে ছিল তার ভীষণ আপত্তি। তার প্রতিষ্ঠিত কলেজের একজন কর্মচারীর কাছেও তিনি ছিলেন ‘শাজাহান ভাই’! প্রকৃতিকে যেমন ভালোবাসতেন, শিশুদেরও তেমন ভালোবাসতেন। যার ফলে তার এলাকা টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে বিভিন্ন রকম ফলদ ও বনজ বৃক্ষ এবং শিশুদের বিনোদনের বিভিন্ন উপকরণ-সংবলিত একটি পার্ক নির্মাণ করেছিলেন। তবে পার্কটির নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এজন্য দুঃখ করে বলতেন, কাজটা আরো আগেই শুরু করা দরকার ছিল।
তিনি শুধুই একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন এর চেয়ে আরো বেশি কিছু। রাজনীতিবিদ হিসেবে ছিলেন স্বতন্ত্র। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘সামনে এগিয়ে যেতে হলে নিরপেক্ষ আত্মসমালোচনার প্রয়োজন।’
তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা, সময়ের সারথি। আপাদমস্তক ব্যতিক্রম রাজনীতিবিদ এবং একই সঙ্গে ইতিহাসের ধারক এবং গর্বিত নির্মাতা— এই জন নেতা কালজয়ী হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন। নিরহংকারী, বিনয়ী, সজ্জন ও নির্মোহ জীবনযাপনের অধিকারী এই রাজনীতিবিদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কালিহাতী শাজাহান সিরাজ কলেজ, টাঙ্গাইল