এ দেশে কোনো অপরাধের একেবারেই বিচার হয় না- এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। মাঝে মধ্যে আমরা বিচারেরও খবর শুনি। এই যেমন, চাল আত্মসাৎ করায় ইউপি চেয়ারম্যান কারাগারে। তবে খবর সাধারণত নি¤œ আদালত কর্তৃক কারাগারে পাঠানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। অনেকে অপরাধ করে কারাগারে যায়, আবার কী করে জানি বেরিয়েও আসে। তবে কারাগারে যাওয়ার খবর বা বেরিয়ে আসার খবর প্রকাশিত হলেও শাস্তির কোনো খবর সহজে পাওয়া যায় না। আদালত যে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয় সেটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাজারবার প্রমাণ হয়েছে। বিচারের রায় উল্টে দিতে অনেক বিচারককে পত্রপাঠ বদলি করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিচারব্যবস্থা ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। উচ্চ আদালত মাঝে মধ্যে উষ্মাও প্রকাশ করেন। তাতে নি¤œ আদালত নিয়ন্ত্রণে সরকারি মনোভাবে কোনো পরিবর্তন হয় না। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অপসারণ এবং তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা। এরপর আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন পড়ে না। এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার কারিগর এক-এগারোর সরকার তো উচ্চ আদালতের বিচারকদের চায়ের দাওয়াত দিয়ে বিদায় করেছিল কিংবা তাদের মনমতো রায় দিতে বাধ্য করেছিল। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কিছুকাল আগে একটি খবর দেখেছিলাম, এক ব্যাংক কর্মকর্তা বিনাবিচারে ৪৪ বছর কারাগারে আটকে আছেন। ৫২ বছর বয়সে কারাগারে নেয়া হয়েছিল তাকে, এখন বয়স ৯২। থুত্থুড়ে বৃদ্ধা, হাতে মুখে পানি এসে গেছে, হাত-পা কাঁপে, চোখ দুটো ফ্যাকাশে, শূন্যদৃষ্টি, ইতোমধ্যে ডাবল যাবজ্জীবন খাটা হয়ে গেছে। মামলা শেষ হয়নি, মুক্তিও মেলেনি। এমনি ঘটনা একটি দু’টি নয়, শত শত। এখন সরকার বিভিন্ন ধরনের নিবর্তনমূলক আইন জারি করেছে। ফলে যাকে তাকে যখন-তখন গ্রেফতার করে কারাগারে রেখে দেয়া যায়। বিচার সহজে হয় না। এদের পচে মরতে হয় কারাগারের চার দেয়ালের ভেতরেই। তবে এসব অপরাধী যদি আওয়ামী লীগের কেউ হয়- অর্থাৎ আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগ- তাহলে তাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাদের ক্ষেত্রেই ধর্ষণ মামলা হয়ে যায় দস্যুতা কিংবা ধাক্কাধাক্কির ঘটনা। ছাত্রলীগ হলে তো কথাই নেই। ছাত্রলীগ অবাধে করতে পারে না, হেন কোনো দুষ্কর্ম নেই। পুলিশের মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটে লেখা থাকে ‘পুলিশ’। ছাত্রলীগের মোটরসাইকেলের পেছনেও এমনিভাবে লেখা থাকে ‘ছাত্রলীগ’। অর্থাৎ আমরা পুলিশ কিংবা ছাত্রলীগ- আমরা বিচারের বাইরে। সমাজের হেন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে ছাত্রলীগ অপকর্ম চালাচ্ছে না। টেন্ডারে ভাগ, দোকানে-বাজারে চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই এসব নিয়েই ব্যস্ত ছাত্রলীগ নামধারী বাহিনী। ক্যাম্পাসে হলে সিট বণ্টন থেকে শুরু করে লোমহর্ষক নারী নির্যাতন পর্যন্ত ওদের কর্মক্ষেত্র। লেখাপড়া তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অপরাধ সংঘটিত করলে অসহায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। বড়জোর তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করে কিংবা স্থগিত করে। সাজা ওই পর্যন্তই, এসব তারা পরোয়া করে না। সাধারণত হলে থাকে ও তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগ নেতাদের শারীরিক মানসিক নির্যাতনে এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়। পরিণামে তেমন কিছুই হয়নি। প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ তাদের সহপাঠীদের ওপর ধারাবাহিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। এসবের বেশির ভাগ ঘটনাই দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। মানসম্মানের ভয়ে অনেকেই ঘটনা চেপে যান। কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনো কখনো কোনো কোনো ছাত্রী প্রতিবাদ করেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে এমন বর্বর ঘটনা। ঘটনার দিন রাত আনুমানিক সোয়া ১০টায় এক ছাত্রী তার বন্ধুর সাথে ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে হলের গন্তব্যে যাচ্ছিলেন, তখন পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মী তাদের পথরোধ করে। এত রাতে তারা ক্যাম্পাসে কেন জানতে চেয়ে মারধর শুরু করে। তখন ছাত্রীটির বন্ধু বাধা দিলে তাকে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি লাথি মেরে জখম করে। একপর্যায়ে আসামিরা ভুক্তভোগী ছাত্রী ও তার বন্ধুকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা হলের পেছনে নিয়ে যায়। আসামিরা ওই ছাত্রীর বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয় এবং অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। র্যাব জানায়, ওই ঘটনার নেতৃত্ব দেয় চবি ছাত্র মোহাম্মদ আজীম। আর ওই ছাত্রী ও তার বন্ধুকে আটকের পর মারধর করে বহিরাগত শাওন আর ওই বিবস্ত্র শিক্ষার্থীর দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে মোহাম্মদ আজীম। এ সময় আজীম পরে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক না করলে ধারণকৃত ভিডিও ভাইরাল করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। তারা ওই ছাত্রী ও তার বন্ধুকে প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রেখে দু’টি মোবাইল সেট ও ১৩ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আজীমসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের দু’জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাকি তিনজন হাটহাজারী কলেজের। আসলে এরা বিভিন্ন জায়গায়, ক্যাম্পাসের বাইরেও দুর্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। ডাকাত দল যেমন একই এলাকার, একই গ্রামের লোক হয় না। বিভিন্ন এলাকার ডাকাতদের নিয়ে দল গঠিত হয়, ছাত্রলীগও তেমনি দলে দলে ভাগ হয়ে, দল গঠন করেছে মনে হয়। কারণ আটক পাঁচ অপরাধীই ছাত্রলীগের কর্মী। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি, রুবেলের নাম এ ঘটনায় উঠে আসে। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, ঘটনায় জড়িত অপরাধীরা সবাই তার অনুসারী। ভুক্তভোগী সেই ছাত্রী ঘটনার পরের দিন প্রক্টরের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে সেখানে উপস্থিত রুবেল তাকে সম্মানহানির অভিযোগ দিয়ে বাধা দেন। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। রুবেলের দাবি- ভিক্টিম ছাত্রী তার কর্মী। ঘটনার পরদিন সে রুবেলকে ফোন দেয়, তাই সে তাকে সহযোগিতা করেছে, বিষয়টি এখন ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর আটক চারজনের মধ্যে শুধু আজীম তার সিএফসি গ্রুপের কর্মী। বাকি তিনজন ভিএক্স গ্রুপের কর্মী। এ ঘটনায় জড়িত তথাকথিত ছাত্রদের বিচার দাবিতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলেছে। এদিকে, ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিন আক্তার। তবে, এরকম ন্যক্কারজনক পৈশাচিক ঘটনার শাস্তি কি শুধুই বহিষ্কার? তাদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা নয় কেন? সে কথা কেউ বলতে পারে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবিরাম ‘ফটর ফটর’ করেন। যা কিছু কথা বলেন, তা শতকরা নিরানব্বই ভাগ বিএনপিকে গালিগালাজ। তিনি হাওয়ায় ভেসে বেড়ান। এমনভাবে চলেন, যেন দু’চোখে কিছুই দেখেন না। কানেও কিছু শোনেন না। একসময় তিনি বড়াই করে বলতেন, বিএনপিকে শায়েস্তা করার জন্য আওয়ামী লীগের দরকার নেই, ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তখনো ছাত্রলীগ এই চরিত্রেরই ছিল। শায়েস্তা তো দূরের কথা, এ রকম অপরাধী কাউকে কাউকে ছাত্রলীগ থেকে সরিয়ে যুবলীগের উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, শাহজালাল হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্রলীগ যে পৈশাচিক বর্বরতা ঘটিয়েছে, হ্যালো ওবায়দুল কাদের, সে সম্পর্কে মানুষ হিসেবে আপনার মুখ খুলুন। এরকম ঘটনা ছাত্রলীগ ঘটালে চুপ করে থাকেন কেন? একটা কিছু বলুন। বলুন, ছাত্রলীগ যা করেছে, যথার্থই করেছে। বলুন, বিএনপির আমলে এর চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে, সে তুলনায় ছাত্রলীগের ঘটনা তো নস্যি। আপনি বলুন, আমরা শুনি। আপনি বললে ভালো হয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, চেলাচামু-ারা সারা দেশে সে কথাই বলতে থাকবে, খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার অভিনেতা ও লেখক মরহুম আমজাদ হোসেন একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। তার নাম ছিল ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’। তাতে বিখ্যাত সংলাপ ছিল ‘একটা কিছু ক’রে গোলাপি, একটা কিছু ক’। ছাত্রলীগ নিয়ে ওবায়দুল কাদেরকেও আমরা বলতে চাই, ‘একটা কিছু কন কাদের, একটা কিছু কন।’ লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক rezwansiddiqui@yahoo.com