স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুমারিতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে, তখন এই শহরের জনসংখ্যা দেড় কোটির মতো। প্রতিদিন বাড়ছে ঢাকার জনসংখ্যা। জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজধানী ঢাকায় জনদুর্ভোগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে এক হাজার ৭০০। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হবে। এতো মানুষের আবাসন, কর্মসংস্থান সবই হয়েছে ঢাকায়। এতে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগরী। এখন সরকার ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার সুফল পাচ্ছে না জনগণ। উল্টো নগরে যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যা বেড়েই চলছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ছোট্ট এ ঢাকায় মানুষ এভাবে আসতে থাকলে এই শহরের সমস্যা কখনোই সমাধান হবে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যাও বাড়বে। ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিংসেবাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সেবাব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধান করতে হবে। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে ঢাকার বাইরে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসার প্রয়োজন বোধ না করে।
সংশ্লিষ্টদের অতিদ্রুত ঢাকায় অবস্থিত প্রধান অফিসগুলোকে যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেত, গ্রামীণ এলাকায় শিল্প-কলকারখানা তৈরি করে নিত্যনতুন কর্মসংস্থান করা সম্ভব হতো, কৃষি ও গবাদিপশু পালনের ওপর জোর দেয়া যেত, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনব্যবস্থাকে আরও বেশি কার্যকর করা যেত, তবে ঢাকায় বিরাজমান জনগণের চাপ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনার পাশাপাশি এ শহরকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো। বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি; প্রতি বছর শহরের সব স্থানেই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির প্রকট সংকট; যা প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রপত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন, চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে ঢাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত ও নি¤œ আয়ের মানুষের জীবন তাদের বর্তমান আয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের অধিকাংশকেই ধার-কর্জনির্ভর জীবনযাপনে বাধ্য হতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে সংসারের ভরণ-পোষণের দায়ে ব্যাংকে গচ্ছিত সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। কেউ কেউ ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে কার্ডের প্রদত্ত অর্থ খরচ করে এখন বেতনের টাকা থেকে মাসে মাসে এসব কার্ডের চক্রবৃদ্ধি সুদের ঘানি টানতে টানতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। এসব মানুষ প্রতি মাসে বেতন বাবদ যা উপার্জন করছে, তার প্রায় অর্ধেকের বেশি অর্থ মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাড়ি ভাড়া বাবদ বাড়িওয়ালাকে দিয়ে আসতে হচ্ছে। বাড়ি ভাড়া দেয়ার পর বাদবাকি যে অর্থ তাদের হাতে অবশিষ্ট থাকছে তা দিয়ে সংসারের ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটানো সত্যিই এ দুর্মূল্যের বাজারে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারপরও প্রতিদিন পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি ঢাকাবাসীকে আরও নাকাল করে ফেলেছে। প্রয়োজনীয় গ্যাস ও পানি না থাকার কারণে ঢাকাবাসী বর্তমানে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, পাশাপাশি রয়েছে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি। বর্তমান আয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে যদি পরিবারের কেউ অসুস্থ হয় তবে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার মান একেবারে নেই বললেই চলে। তাই এসব মানুষকে বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার ব্যয় ও চিকিৎসকের ফি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসব কারণে ঢাকাবাসী আর্থিকভাবে বর্তমানে আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পরিবারে অতিথির আগমন তো রয়েছেই। অতিথি আপ্যায়ন করতেও এসব মানুষের ধার-কর্জের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা মাসের বেতনের ওপর প্রভাব পড়ছে। কিন্তু এসব মানুষ যদি নিজ এলাকায় কর্ম করে খাবার সুযোগ পেত তবে নিজ বাড়িতে থেকে হয়তো তাদের এত অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। মানুষের কাছে দেশের মোট প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই, তারা চায় দ্রব্যমূল্যের সহনীয় পরিস্থিতি। তারা চায় লাগামহীন বাড়ি ভাড়া রোধকল্পে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংকট থেকে চায় স্থায়ী মুক্তি। তারা চায় দেশে মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কথায় না কাজে সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। এই সামান্য চাওয়ার বিপরীতে মূল্য বৃদ্ধির খড়গ পড়ছে মূলত জনগণের ঘাড়ে। এ জন্য সরকারকে বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থা অর্জনে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় সেবার মান বাড়াতে হবে, জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে হবে। বাজারব্যবস্থা আরও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি