মামলাবাজ মরিয়ম মান্নানের কাহিনী
নিখোঁজের ২৯ দিন পর উদ্ধার রহিমা বেগম এখন ঢাকায়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রোববার দিবাগত রাত ন’টায় খুলনা থেকে রওয়ানা দিয়ে রাত আড়াইটার দিকে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। রহিমা বেগমের সঙ্গে মেয়ে মরিয়ম মরিয়ম, আদুরী ও বড় দুলাভাইও ঢাকায় এসেছেন। মরিয়ম জানান, খুলনায় তার মা নিরাপদ বোধ করছেন না, তাই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি আরো জানান, নিরাপদে ঢাকার বসুন্ধরার বাসায় পৌঁছেছেন তারা। সোমবার রহিমা বেগম চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন। তার ওপর জোর দিচ্ছেন মেয়েরা। এদিকে, বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে রহিমার মামলার তথ্য দিয়েছেন প্রতিবেশীরা। এমনকি মরিয়মের মামলাবাজির হাত থেকে রেহাই না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তার স্বামী বেলাল হাওলাদারও। গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে নিখোঁজ হন মরিয়ামের মা রহিমা বেগম। ফরিদপুরের বোয়ালখালী থেকে উদ্ধার হওয়ার পর, আদালতের আদেশে আরেক মেয়ে আদুরীর হেফাজতে ছেড়ে দেয়া হয় রহিমা বেগমকে। তবে তিনি বনিকপাড়ায় ফিরে আসেননি। এদিকে রহিমা বেগম ও তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান মামলাবাজ-এমন অভিযোগ করেছেন তাদের প্রতিবেশীরা। তাদের মামলায় ভোগান্তির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন।
রহিমা বেগমের মামলার আরেক ভুক্তভোগী শরীফুলের বয়স যখন দশ বছর, তখন তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছিলেন রহিমা বেগম। রহিমার নিখোঁজ মামলায় আটক পাঁচ জনের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে আত্মগোপন করেন রহিমা। শুধু প্রতিবেশী নয়, রহিমা বেগমের বর্তমান স্বামী বেলাল হাওলাদারও রেহাই পাননি। তার দাবি, অপহরণ মামলায় কথা মতো সাক্ষ্য না দেয়ায় তাকেও ফাঁসিয়েছে রহিমার মেয়ে মরিয়ম। রহিমার চতুর্থ স্বামী বেলাল। প্রথম স্বামী মারা যাবার পর আরও দুবার বিয়ে করেন রহিমা বেগম। তবে প্রথম স্বামীর ঘরেই তার ছয় সন্তান, অন্য স্বামীদের ঘরে তার কোনো সন্তান নেই।
এদিকে, রহিমা বেগম নিখোঁজ হওয়ার পর যে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিলো সেগুলো আর রাখবেন না বলে জানিয়েছেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। উল্লেখ্য, খুলনার দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা এলাকার নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগম অক্ষত অবস্থায় শনিবার রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা থেকে উদ্ধার হন।
কারাগারে থাকা গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী আয়েশা বলেন, ‘আমার স্বামীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমাদের সমাজের কাছে ছোট করা হয়েছে। আমরা রহিমা বেগম, তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান, ছেলে মিরাজসহ এ ঘটনার পেছনে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর যারা মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে অবিলম্বে তাদের মুক্তি চাই।’ খুলনার মহেশ্বরপাশা থেকে নিখোঁজ হওয়া মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম এখন আছেন পরিবারে স্বজনদের সঙ্গে। তবে তিনি নিখোঁজ হওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার ৬ জনের আশু মুক্তি মিলছে না।
মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, রহিমা বেগমের জবানবন্দির ভিত্তিতে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য গ্রেপ্তার ছয়জনকে রিমান্ডে নেয়া হবে।
অন্যদিকে স্থানীয়রা বলছেন, রহিমা বেগম অপহরণের শিকার হননি; তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মা ও মেয়েরা মিলে এই নাটক সাজিয়েছিলেন।
ফরিদপুরে বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি অপহরণের শিকার বলে দাবি করেন। পরে মেয়ে আদুরী আক্তারের জিম্মায় তাকে মুক্তি দেয় আদালত। এর আগে ২৭ আগস্ট রাতে দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়ার বাড়ি থেকে রহিমা নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ করেন তার মেয়ে মরিয়ম ও তার ভাই-বোনেরা। পরদিন দৌলতপুর থানায় মামলা করেন রহিমার মেয়ে আদুরী। আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে। সেই মামলায় প্রতিবেশী মঈন উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, রফিকুল ইসলাম পলাশ, মোহাম্মদ জুয়েল, হেলাল শরীফ ও রহিমা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী বেল্লাল হাওলাদার কারাগারে রয়েছেন।
কারাগারে থাকা গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী আয়েশা বলেন, ‘রহিমা বেগমের সতীনের কাছ থেকে তাদের বাড়ির ২ কাঠা জমি একজন মুহুরি কেনে নেন। সেই মুহুরির কাছ থেকে আমার স্বামী ওই জমি কেনেন। এর পর থেকেই রহিমা বেগম ও তার ছেলে-মেয়েরা আমাদের মিথ্যা মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন। তাদের হয়রানির শিকার প্রতিবেশী সবাই। তাদের সবাইকে এলাকার লোকজন মামলাবাজ হিসেবে চেনে। ভয়ে তাদের সঙ্গে এলাকার কেউ কথা বলে না।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমাদের সমাজের কাছে ছোট করা হয়েছে। আমরা রহিমা বেগম এবং তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান, ছেলে মিরাজসহ এ ঘটনার পেছনে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর যারা মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে অবিলম্বে তাদের মুক্তি চাই।’ কারাগারে থাকা নূর আলম জুয়েলের স্ত্রী সুমি বলেন, ‘রহিমা বেগমের পরিবারের সদস্যরা খুব উচ্ছৃঙ্খল। এর আগেও রহিমা বেগম নিজের হাত নিজে কেটে আমাদের নামে মামলা দিয়েছেন। এবার আত্মগোপন করে তার মেয়েকে দিয়ে আমার স্বামীর নামে মিথ্যা মামলা করেছেন। এখন আমার স্বামী কারাগারে বন্দি। আমার এক ও দুই বছরের সন্তান তার বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। আমরা রহিমা বেগম ও তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানের কঠোর শাস্তি চাই।’
হেলাল শরীফের স্ত্রী মনিরা আক্তার বলেন, ‘বিনা অপরাধে জেল খাটছেন আমার স্বামী। আগস্টের ৩০ তারিখে আমার স্বামী আটক হন। আর সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে আমার মেয়ে হয়েছে। অক্টোবরে আমার বাচ্চার ডেলিভারির তারিখ ছিল। কিন্তু স্বামী আটক হওয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আগেই সিজার করা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমি আমার স্বামীকে কাছে পাইনি।
‘আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে আটককৃতরা কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। আমার স্বামী বের হলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব। আশা করছি, দ্রুত আমার স্বামী ছাড়া পাবে।’
রহিমা বেগমের প্রথম স্বামীর নাম মান্নান হাওলাদার। মহেশ্বরপাশায় তিনি কবিরাজি করতেন। এই স্বামীর ঘরে রহিমার পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর বেল্লাল হাওলাদার রহিমা বেগমের এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। এরপর রহিমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। তিন-চার বছর আগে এই বেল্লালকেই রহিমা বেগম বিয়ে করেন।
প্রতিবেশীরা জানান, প্রথম স্বামীর কাছ থেকে ১৯ দশমিক ৩৪ শতক জমির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন রহিমা বেগম। সেই স্বামীর প্রথম স্ত্রীকে জমি দেয়ার পর ২০১৯ সালে তার বাড়ির বিপরীত পাশে অবস্থিত গোলাম কিবরিয়া ও হেলাল শরীফের কাছে ৪ দশমিক ৮৬ শতক জমি বিক্রি করেন। এরপর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে জমি নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। মামলা-পাল্টা মামলা, হুমকি-পাল্টা হুমকির ঘটনা ঘটে একাধিক বার। এ নিয়েই মূলত এতোসব কাহিনী।
মরিয়মের প্রতিবেশী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘জমি দখল করতে গেলে তারা মারামারি শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তা থানা পুলিশ ও আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক বছর আগে এ নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে তাদের মারামারি হয়। সেই থেকে স্থানীয়রা তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না।
‘ওই জমি দখলে রাখতে তারাই নাটক সাজিয়েছে। আমরা আগেও থানা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। কারণ অন্যের কেনা জমি তারা দখল করে রাখলেও আদালত একদিন রহিমা বেগমের বিপক্ষে রায় দেবে। সেদিন জমি ছেড়ে দিতে হবে। শুধু জমি দখলছাড়া না করতে তারা এই নাটক সাজিয়েছেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুলনা পিবিআই পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘রহিমা বেগম আদালতে অপহরণের জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা সেই কপি নিয়ে তার কথার সত্যতা যাচাই করব। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা কারাগারে আছেন। ইতোপূর্বে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। এখনও শুনানি হয়নি। মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তদন্তে সব রহস্য উদঘাটন হবে।’