মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং করোনার কারণে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে উপকূলীয় জেলেদের। দীর্ঘ সময় মাছ ধরতে না পারায় তাদের এই ক্ষতি গত বছরের তুলনায় বেশি। বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত অনলাইস সংবাদ সম্মেলনে এই জরিপ প্রতিবেদন জানানো হয়। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, শতকরা ৮৪ দশমিক ৩ জন উত্তরদাতা জেলে জানিয়েছেন, করোনার কারণে তাদের আয় কমেছে। অনলাইন সংবাদ সম্মেলনটি পরিচালনা করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেছেন সংস্থাটির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শেখ গিয়াসউদ্দীন আহমেদ এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস-ইউল্যাব এর শিক্ষিকা ড. রোমানা সুলতানা।
মোট ১ হাজার ১৮ জন উত্তরদাতা জরিপে অংশ নিয়েছিলেন। এরমধ্যে ৫১৯ জন পাথরঘাটার ও ৪৯৯ মহেশখালির। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩০৬ জন নারী এবং ৭১২ জন পুরুষ। প্রসঙ্গত, গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মাছধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় ৪টি ইউনিয়নে মার্চ থেকে ২০ মে পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ ছিল করোনার কারণে।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, শতকরা ৮৪ দশমিক ৩ জন উত্তরদাতা জেলে জানিয়েছেন, করোনার কারণে তাদের আয় কমেছে। আর মাত্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ জেলে জানিয়েছেন তাদের আয়ে কোনও পরিবর্তন আসেনি। পরিবারপ্রতি মাসিক আয় কমে হয়েছে ৫ হাজার ১৩৮ টাকা, সেই হিসেবে প্রতিদিনের আয় দাঁড়িয়েছে ১৭১ টাকা। জেলেরা জানিয়েছেন করোনার আগে তাদের পরিবারপ্রতি গড় আয় ছিল ১১ হাজার ১২৫ টাকা। সেই হিসেবে প্রতিটি পরিবার প্রতিদিন আয় করতো ৩৭০ টাকা। উত্তরদাতা ৫৮০ জন জেলের অর্থাৎ শতকরা ৫৬ দশমিক ৯৭ জনের মাসিক আয় ছিল ৫০০১ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা। বাকি ২৯৯ জন অর্থাৎ শতকরা ২৯ দশমিক ৩৭ জন বলেছেন, তাদের আয় ছিল ১০ হাজার ১ থেকে ১৫ হাজার টাকা। শতকরা ১৭ জন জেলের আয় ৮১ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ কমেছে। বাকি ২৪ শতাংশ জেলের আয় কমেছে ৬১ থেকে ৮০ শতাংশ ।
শতকরা ৭৪ দশমিক ৪ জন উত্তরদাতা জানিয়েছেন, করোনা চলাকালে তারা কোনও সাহায্য পাননি। শতকরা ৮৩ দশমিক ২ জন উত্তরদাতা জানিয়েছেন তারা ঋণ নিয়ে ঘাটতি মোকাবিলা করেছেন। শতকরা ৩২ দশমিক ৮ জন জেলে বলেছেন, এসময় তাদের কোনাও আয় ছিল না। বাকিদের মাসিক আয় ছিল ৩ হাজার ২০৮ টাকা, যা দিনপ্রতি পুরো পরিবারের জন্য দাঁড়ায় মাত্র ১০৬ টাকা। শতকরা ৩২ দশমিক ৮ জন দিনমজুর হিসেবে কাজ করেছেন। শতকরা ১৬ দশমিক ৫ জন নৌকা ও জাল বানিয়ে দিন কাটিয়েছেন। ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা খাদ্য সহায়তা ও নগদ টাকা পেয়েছেন। ৮৬ দশমিক ৭ জনের জেলে হিসেবে মৎস্য কার্ড ছিল। ৬৬ দশমিক ২ শতাংশ জানতেন না যে তাদের জন্য আসলে সরকারি সহায়তা কতটুকু। শতকরা ৩৮ জন উত্তরদাতা জেলে জানিয়েছেন, তাদের ৮১ শতাংশ থেকে শুরু করে সম্পূর্ণভাবে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর আরও ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা জেলে জানিয়েছেন, তাদের আয়ের পথ ৬১ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে।
শতকরা ৫৬ দশমিক ৭ জন উত্তরদাতা জানিয়েছেন, করোনার কারণে স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে খুব বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন তারা লক্ষ্য করেননি। তবে শতকরা ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, তাদের পরিবেশ পরিষ্কার হয়েছে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে তিন পরিচ্ছন্নতা মানা সহজ হয়েছে। শতকরা ৮৯ দশমিক ৯ জন উত্তরদাতা বলেছেন, তারা করোনাকালে স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা ভোগ করেননি।
অন্যদিকে, ৪৯.১ জন জানিয়েছেন শারীরিক নির্যাতনের কথা। শতকরা ৬২ জন নারী মনে করেন এইসময় পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতা ঠেকানোর কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি শতকরা ৯৪ জনের। সুপারিশ হিসেবে বলা হয়েছে যে, জেলেদের আপদকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য অন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটা জরুরি। সংবাদ সম্মেলনে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) তাদের সাসটেইনবল ওশান প্রকল্পের অধীনে ডেনিস ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস-এর সঙ্গে পরিচালিত টেলিফোন জরিপ প্রতিবেদনটি তুলে ধরে। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল করোনাকালীন সময়ে এবং পরবর্তীতে ৬৫ দিন মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলে সম্প্রদায়ের অবস্থা বোঝা। সুইডিশ সিডার সহায়তায় দেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জেলেদের জীবন ও মানবাধিকার নিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সংস্থা দুটি। বেসরকারি সংস্থা বিলস ও কোস্ট ট্রাস্ট তথ্য সংগ্রহের কাজে সহযোগিতা করেছে। জরিপ পরিচালিত হয়েছে তাদের কর্ম এলাকায়। জরিপটি পরিচালনা করেছে এমজেএফ এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস-এর সেন্টার ফর সাসটেইনাবেল ডেভেলপমেন্ট।