বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। এবছর সেই সংকটের চিত্রটা খুবই স্পষ্ট। ২০২২ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) প্রকাশিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকের বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। মোট ১৮০টি দেশকে নিয়ে প্রকাশিত এই র্যাংকিংয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। এ বছর ঠিক দশ ধাপ অবনতি। বর্তমানে মিয়ানমার ব্যতীত প্রতিবেশি যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এই তালিকায় ভারত ১৫০তম, পাকিস্তান ১৫৭তম, শ্রীলঙ্কা ১৪৬তম এবং নেপাল ৭৬তম অবস্থানে রয়েছে।
তবে সংবিধানের সূচনালগ্ন থেকেই দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তারই ভিত্তিতে বাংলাদেশে বর্তমানে এমআরডিআই’র ২০২২ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী অন্তত ১,৩২৩টি দৈনিক সংবাদপত্র, ৩০টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও, ১৮টি কমিউনিটি রেডিও ও ১৭৭টি অনলাইন পোর্টাল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিশ্ব র্যাংকিংয়ে দেশের নাম এতটা তলানিতে যাওয়ার কারণ কী।
আরএসএফের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সরকারগুলো গণমাধ্যমকে একটি প্রচারণার সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ২০০৯ সাল থেকে পরপর ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারও তার ব্যতীক্রম নয়।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চক্ষশূলে পরিণত হওয়া সাংবাদিকদের বরণ করতে হয় নানা রকম হয়রানি ও নির্যাতন। এছাড়া বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সরকারের তৈরি নানা আইনের মারপ্যাঁচে চেপে রাখা হয় সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কণ্ঠ। ফলে সরকারের কথা বা কাজকে চ্যালেঞ্জ করার ‘দুঃসাহস’ দেখাতে পারে না কোনো সংবাদমাধ্যম।
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে অন্তত ৩৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ৭ বছরে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৪ জন সাংবাদিক। নিহত সাংবাদিকদের ৬১ শতাংশের মামলা এখনও অমিমাংশিত বা ঝুলে আছে। ২০১২ সালে নৃসংশভাবে খুন হওয়া আলোচিত সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ এ পর্যন্ত ৯২ বার পিছিয়েছে। নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে নিখোঁজের তিন দিন পর হাসিবুর রহমান রুবেল নামে কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত এপ্রিলে হত্যাকা-ের শিকার হন কুমিল্লার স্থানীয় এক পত্রিকার সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম। অভিযোগ উঠে, মাদক কারবারীদের নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে তাকে হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
আরএসএফ প্রকাশিত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১৫.৮৮। এই সূচকে ভারত-পাকিস্তানের স্কোর বাংলাদেশের কাছাকাছি হলেও তুলনামূলক বেশি (যথাক্রমে ২০.৬১ ও ১৭.৫৭)। তবে শ্রীলঙ্কা ও নেপালের স্কোর প্রায় দ্বিগুণ (যথাক্রমে ৪১.৩৭ ও ৬৯.৯৯)।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে নর্ডিক দেশগুলো শীর্ষে অবস্থান করছে। এর কারণ হিসেবে গুতেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের সাংবাদিকরা দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত না। ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ওপর কিছুটা রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও, নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈকি প্রভাব তো নেই বরং স্বাধীন সম্পাদকীয় প্রকাশের চর্চা রয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, এই অঞ্চলের গণমাধ্যমগুলোতে অভিবাসন বিষয়ে নেতিবাচক সংবাদ বেশি প্রচার করা হয়। আফ্রিকান দেশগুলোতে সাংবাদিকতার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এশিয়ার তুলনায় তো বটেই, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও আফ্রিকান অনেক দেশে সাংবাদিকতা বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। আরএসএফে’র র্যাংকিংও তাই বলে। র্যাংকিংয়ে নামিবিয়ার অবস্থান ১৮তম, দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৫তম, কাবু ভেরদি ৩৬তম, গাম্বিয়া ৫০তম, নাইজার ৫৯তম, ঘানা ৬০তম।
লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রগুলোর চিত্রও এশিয়ার চেয়ে বেশ ভালো। কোস্টারিকা, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ, আর্জেন্টিনা, ডমিনিকা ও গায়েনা র্যাংকিংয়ে প্রথম ৩৫ এর মধ্যে অবস্থান করছে। এর মধ্যে আর্জেন্টিনায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশটিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উন্নয়নে কাজ করছে বিখ্যাত সাংবাদিকদের নিয়ে গড়া চার শতাধিক সাংবাদিকের একটি প্ল্যাটফর্ম দ্যা ফোরাম ফর আর্জেন্টাইন জার্নালিজম (পিওপিইএ)।
মহাদেশগুলোর মধ্যে তুলনা করলে এশিয়ার দেশগুলোতে সাংবাদিকতা পিছিয়ে আছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে তথ্য নিয়ন্ত্রণের ঝোঁক বেশি হওয়ায় সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে। গণতন্ত্র না থাকায় স্বাধীন সাংবাদিকতার নিশ্চয়তাও নেই অনেক দেশে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঘাটতি অন্যতম হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট চোখে পড়ার মতো। চীন, জাপান, উত্তর কোরিয়ার এমনটাই চিত্র। জাপানে নির্দিষ্ট কিছু গণমাধ্যম ছাড়া সাধারণ গণমাধ্যমকর্মীবা বিদেশি সাংবাদিকরা সরকারি ইভেন্ট কভার করার প্রবেশাধীকার পায় না। সিঙ্গাপুরেও নেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সেখানেও ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি নানা রকম চাপ ও নিয়মনীতির বেড়াজালে বন্দি গণমাধ্যম। এক্ষেত্রে অনেকটাব্যতিক্রম চিত্র দক্ষিণ কোরিয়ায়। আরএসএফের বিশ্ব র্যাংকিংয়েও প্রথম ৪৫ এর মধ্যে অবস্থান করছে দেশটি।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা হননের অন্যতম হাতিয়ার ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইন কোনো ধরনের পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেভাজন বা অভিযুক্তকে তল্লাশি বা গ্রেফতারের অনুমোদন দেয়। আর্টিকেল নাইনটিনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এ আইনের বিভিন্ন মামলায় অন্তত ৫৮ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আটক অবস্থায় নিহত হন লেখক মুশতাক আহমেদ। এ ঘটনা দেশ-বিদেশে এ আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এ আইনকে সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম আইনগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেছে আরএসএফ। এছাড়া দ-বিধি ১৮৬০ এর মানহানি আইন ব্যবহার করেও সাংবাদিক হয়রানির অসংখ্য নজির সৃষ্টি হয়েছে। নদী খনন প্রকল্পে ঠিকাদারদের ড্রেজার দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করার পর মানহানির মামলায় গত আগস্টে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগে প্রায় ৬ বছর ধরে হয়রানির শিকার হয়েছেন সাংবাদিক বদরুদ্দোজা বাবু। এমনকি তাকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল কর্মস্থল থেকেও। বাংলাদেশ ছাড়াও ১৫৯টি দেশে এখনো এ ধরনের আইনের অপপ্রয়োগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মানের দিক থেকে গণমাধ্যমের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ জড়িয়ে আছে অর্থনীতির সাথে। দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমই শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। অর্থনীতির পরিসর বৃদ্ধির সাথে সাথে গণমাধ্যমের বিস্তৃতিও ক্রমশ বাড়ছে। এক শীর্ষ মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন অপারেটরের তথ্য অনুযায়ী দেশে বছরে ১০-১২ শতাংশ হারে গণমাধ্যম শিল্পের বিকাশ ঘটছে। বহিঃবিশ্বে চিত্রও তাই। যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ শতাংশ গণমাধ্যমের মালিকানা কেবল ৬টি কর্পোরেশনের হাতে। এই ব্যবসায়িক শ্রেণি গণমাধ্যমের মানের চেয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার বিষয়ই আগে ভাবেন। ফলে ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় বা শাসক শ্রেণির রোষানলে পড়তে হয় এমন ভূমিকা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে গণমাধ্যমগুলো। এছাড়া মালিক শ্রেণির রাজনৈতিক আদর্শও প্রবলভাবে ফুটে উঠে নিজ নিজ গণমাধ্যমে। এতে সাংবাদিকরা যেমন উৎসাহ হারান, একইসাথে তারা নিরাপত্তা সংকটে ভোগেন। এক্ষেত্রে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমের চিত্রই প্রায় অভিন্ন। এভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতির কবলে পড়ে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতা। লেখকঃ শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়