করোনায় আক্রান্ত ‘ক্রিটিক্যাল’ রোগীর সংখ্যা আবার বাড়ছে
সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে আরও ৩১ জন মারা গেছেন। এদের মধ্যে পুরুষ ২৫ জন ও নারী ৬ জন। ৩১ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৮ জন ও বাড়িতে ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল চার হাজার ৭৩৩ জনে। করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৪টি করোনা পরীক্ষাগারে ১২ হাজার ৮৫০টি নমুনা সংগ্রহ হয়। পরীক্ষা হয়েছে ১২ হাজার ৯৯৯টি। একই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৪৭৬ জন। ফলে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল তিন লাখ ৩৭ হাজার ৫২০ জনে। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৮০টি। গতকাল রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনাভাইরাস বিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর মৃত্যু বাড়ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে করোনা নিয়ে অসেচতনতা, বাসায় বসে টেলিমেডিসিন সেবা, টেস্ট করতে গিয়ে ভোগান্তির কারণে টেস্ট না করার মানসিকতা এবং দেরি করে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাঝে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে ক্রিটিক্যাল বা সিভিয়ার রোগীর সংখ্যা কম থাকায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ফাঁকা ছিল। তবে গত কয়েক সপ্তাহে আইসিইউতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর) করোনাভাইরাসে মারা গেছেন আরও ৩৪ জন। এ নিয়ে করোনায় মোট মারা গেলেন চার হাজার ৬৬৮ জন। সর্বশেষ মারা যাওয়া ৩৪ জনই হাসপাতালে মারা গেছেন। এর আগে, গত ২ সেপ্টেম্বর ৩৫ জন, ৩০ আগস্ট ৪২ জন, ২৯ আগস্ট ৩২ জন আর গত ৩১ জুলাই ২৮ জনের সবাই হাসপাতালে মারা যান।
দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। দেরিতে হাসপাতালে আসার কারণে করোনায় মৃত্যুহার বাড়ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমও। তিনি বলেন, ‘আমরা বলছি, যদি শ্বাসকষ্ট না থাকে, অন্যান্য জটিলতা না থাকে তাহলে হাসপাতালে আসার দরকার নেই। কিন্তু যাদের কোমরবিড ইলনেস যুক্ত (যেমন–ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসার অথবা এমন কোনও রোগ রয়েছে যে জন্য তাকে স্টেরয়েড খেতে হয়) রোগীরা কোভিডে আক্রান্ত হলে তাদের বাসায় রাখা যাবে না। কারণ, এসব রোগীর “এক্সট্রা সার্পোট” দরকার হয়, যেগুলো বাড়িতে দেওয়া সম্ভব নয়।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, গত কয়েক সপ্তাহ আইসিইউ বেড অনেকাংশে ফাঁকা ছিল, কিন্তু এখন সে সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। সারাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৫৪৭টি, ১১ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী আইসিইউতে রোগী ভর্তি আছেন ২৮৬ জন আর শয্যা ফাঁকা রয়েছে ২৬১টি। আবার ঢাকা শহরের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ৩০৭টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে রোগী রয়েছেন ১৭৮ জন আর বেড ফাঁকা রয়েছে ১২৯টি। এর মধ্যে করোনা ডেডিকেটেড হিসেবে প্রধান তিনটি সরকারি হাসপাতালেই কোনও আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড ফাঁকা থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে উপচেপড়া রোগী। এমনকি রোগী বেশি হওয়ায় ভর্তি হতে পারছেন না– এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ‘ভর্তি হওয়া এসব রোগী প্রকৃতপক্ষে মডারেট স্টেজ পার হয়ে সিভিয়ার স্টেজে চলে গেছে। এ অবস্থায় আর কিছু করার থাকছে না। এখন হাসপাতালগুলোতে সিভিয়ার রোগীই ভর্তি হচ্ছে, মডারেট কেস খুবই কম।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে থাকা ১৬টি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০টি এবং মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১৪টি আইসিইউ বেডের সবগুলোতে এখন রোগী রয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব বাড়ছে দিনকে দিন, আর এজন্য দায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর অধিদফতর। যার কারণে হাসপাতালে যারা যাচ্ছেন তারা একেবারে “বেশি সমস্যা” নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই শেষ পর্যায়ে হাজির হচ্ছে হাসপাতালে, এ কারণে তাদের বাঁচানো যাচ্ছে না।’ হাসপাতালে মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, ‘নীতিনির্ধারকদের কথায়, মানুষের মধ্যে “গা সওয়া” ভাব চলে এসেছে। এ কারণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন, কিন্তু তখন আর করার কিছু থাকছে না।’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনা রোগীর সংখ্যা কমলেও “সিভিয়ার” রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।’ গত ৯ সেপ্টেম্বর একদিনে ১৯ ব্যাগ প্ল্যাজমার জন্য আবেদন পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জন্য “হিউজ” একটা সংখ্যা।’
সরকার এবং সাধারণ মানুষ টেস্ট কম করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে টেস্টের ফলাফল দেরিতে পাওয়া, টেস্ট করতে গিয়ে ভোগান্তি– এসব কারণে মানুষ করোনার টেস্টে আগ্রহ হারিয়েছে। লক্ষণ থাকলেও বাড়িতে অপেক্ষা করা ছাড়াও কিছু বাজে টেলিমেডিসিন সেন্টারের কারণেও মানুষ বেশি অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাচ্ছে, তার আগে নয়। আর অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কারণেই প্লাজমার চাহিদা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর হার।’ ‘মাঝে হাসপাতালে রোগী কম আসছিল। কিন্তু এখন আবার প্রথমদিকে যেরকম ছিল, উপচেপড়া ভিড় এবং হাসপাতালের বেড শতভাগ অকুপায়েড– সেদিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি।’ বলেন বেসরকারি এএমজেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন এবং আইসিইউ বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ সায়েম।
তিনি বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমদিকে খারাপ অবস্থায় থাকা রোগী এত ছিল না। এখন হাসপাতালগুলোতে খারাপ রোগীর সংখ্যাই বেশি।’ নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ডা. সায়েম বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে ৯৭ বছরের রোগীকেও আমরা সুস্থ করতে পেরেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে খুব একটা মৃত্যু আমরা পাইনি, কিন্তু যারা দেরিতে এসেছে তাদের মৃত্যু পেয়েছি।’ ‘কোভিডের ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ শতাংশের জ্বর একদিন অথবা দুই দিন থেকে চলে যায়। তখন অনেকেই ভাবেন কোভিড হোক বা অন্য সাধারণ অসুস্থতা হোক সেটা চলে গেছে, সুস্থ হয়ে গেছি। এই ধারণা কোভিডের ক্ষেত্রে ভুল। শারীরিক বহিঃপ্রকাশ রোগের গতিপ্রকৃতিকে ইন্ডিকেট করতে পারে না কোভিডের ক্ষেত্রে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে যখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তখন সেটা অ্যাডভান্সড স্টেজ হয়ে গেছে। তখন খুব বেশি কিছু করার থাকছে না।’ বলেন ডা. সায়েম। ‘কোভিডের ক্ষেত্রে একটি ভুল বার্তা যাচ্ছে যে, বাসায় থাকা রোগীর যদি অক্সিজেন কমে যায় তাহলে বাসাতেই অক্সিজেন দিলে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার কাছে এই বার্তা ভুল মনে হয়’ মন্তব্য করেন ডা. সায়েম। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে অক্সিজেন কমার কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা না করা হলে বুঝতে হবে তার চিকিৎসা হচ্ছে না। কারণ আমি তার অক্সিজেন কমে যাবার কারণেই যেতে পারছি না। এমন অনেক রোগী পেয়েছি, বাসায় থেকে যখন আর অক্সিজেন নিয়েও উন্নতি হচ্ছে না তখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। কিন্তু তখন আর তাদের আমরা হেল্প করতে পারছি না।’
রাজধানীর বেসরকারি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, প্রথম দিকে সাধারণ শয্যা, আইসিইউ সব পূর্ণ ছিল। মাঝে কম ছিল। এখন আবার আগের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।
করোনায় ২৪ ঘণ্টায় ৩১ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১৪৭৬: সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে আরও ৩১ জন মারা গেছেন। এদের মধ্যে পুরুষ ২৫ জন ও নারী ৬ জন। ৩১ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৮ জন ও বাড়িতে ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল চার হাজার ৭৩৩ জনে। করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৪টি করোনা পরীক্ষাগারে ১২ হাজার ৮৫০টি নমুনা সংগ্রহ হয়। পরীক্ষা হয়েছে ১২ হাজার ৯৯৯টি। একই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৪৭৬ জন। ফলে দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল তিন লাখ ৩৭ হাজার ৫২০ জনে। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৮০টি। গতকাল রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনাভাইরাস বিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও দুই হাজার ৩৭২ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল দুই লাখ ৪০ হাজার ৬৪৩ জনে। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। রোগী শনাক্তের তুলনায় সুস্থতার হার ৭১ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪০ শতাংশ। এ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃতের মধ্যে পুরুষ তিন হাজার ৬৮৬ (৭৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) এবং নারী এক হাজার ৪৭ জন (২২ দশমিক শূন্য ১২ শতাংশ)। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত ৩১ জনের মধ্যে ত্রিশোর্ধ্ব একজন, চল্লিশোর্ধ্ব দুইজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব সাতজন এবং ষাটোর্ধ্ব ২১ জন রয়েছেন। বিভাগ অনুযায়ী, ৩১ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৮ জন, চট্টগ্রামে পাঁচজন, রাজশাহীতে দুইজন, খুলনায় একজন, সিলেট দুইজন, রংপুর দুইজন এবং ময়মনসিংহে একজন রয়েছেন।