সন্তানের অধিকার হলো- মাতা-পিতা তাদের মাঝে সমতা রক্ষা করবে। ছেলে হোক মেয়ে হোক মাতা-পিতার কাছে উভয়ই সমান, তাই মাতা-পিতার আচার-আচরণ স্নেহ-মমতা, দান-অনুদান, শাসন-অনুশাসন, এসব কিছুতেই সব সন্তানের প্রাপ্য সমান। এ বিষয়ের প্রতি মাতা-পিতার বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। কারণ সন্তান ছোট হলেও এ বিষয়গুলো সে খুব অনুভব করে। ফলে বড় হলে মাতা-পিতার শেষ বয়সে সন্তান শ্রদ্ধাশীল হয় না এবং ভাইবোনদের মধ্যে সম্পর্কও ভালো থাকে না। আর এ জন্য দায়ী হলো মাতা-পিতার অসম আচরণ। আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচারক, তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারীকে ভালোবাসেন, নিরপেক্ষ আচরণ প্রতিষ্ঠার প্রতি জোরালো তাগিদ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। তোমরা ন্যায়বিচার করো! যা খোদাভিরুতার অধিক নিকটবর্তী। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্মক অবগত।’ (সূরা মায়েদা-৮)
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী আপনি বলুন! আমার প্রভু আমাকে ন্যায়বিচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা যখন বিচার করো! ন্যায়বিচার করো! তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি।’ (সূরা শুয়ারা-১৫)
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতা বা নিকটাত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা গরিব হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্সক্ষী, তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো, কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত।’ (সূরা নিসা-১৩৫)
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার করো। এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো, তোমরা যা করো নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত। (সূরা মায়েদা : ৮-১০)
‘আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তোমরা প্রত্যেক সেজদার সময় স্বীয় মুখম-ল সোজা রাখো, আর তাকে আনুগত্যশীল হয়ে ডাকো। তোমাদের প্রথমে যেমন সৃষ্টি করেছেন, পুনর্বারও সৃজিত হবে।’ (সূরা আরাফ-২৯)
‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন- যাতে তোমরা স্মরণ রাখো।’ (সূরা নাহল-৯০)
রাসূল সা: বলেন, ‘সাত শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন আরশের নিচে ছায়া পাবে, তন্মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হলো ন্যায়বিচারকারী শাসক। মনে রাখা উচিত, মাতা-পিতাও সন্তানের ওপর একজন শাসকের ভূমিকায়, তাই তাদের মধ্যেও সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সদা সজাগ থাকতে হবে, তাদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে না পারা মানে সিরাতে মুস্তাকিম থেকে ছিটকে পড়া, কোনো একজনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অন্যদের খেয়াল না করা অথবা শুধু কন্যাদের প্রাধান্য দেয়া অথবা শুধু ছেলেদের প্রাধান্য দেয়া, মেয়েদের ঠকানো চরম অন্যায় এবং ইনসাফ পরিপন্থী।
হজরত নোমান ইবনে বাশির রা: সূত্রে বর্ণিত, ‘আমার পিতা আমাকে নিয়ে রাসূলের সা:-এর কাছে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, আমি আমার এ পুত্রকে হাদিয়া স্বরূপ একটি কৃতদাস দিয়েছি, রাসূল সা: তাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি তোমার সব সন্তানকে এতটুকু হাদিয়া প্রদান করেছ? পিতা উত্তর দিলেন, না। শুধু নোমানকেই দিয়েছি আর কাউকে দেইনি। রাসূল সা: বললেন, এটা তো ঠিক হয়নি। যাও তা ফিরিয়ে নাও।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘তুমি কি এটা চাও না যে তোমার সব সন্তানই সমান হারে তোমার আনুগত্য করুক, তোমার সেবা করুক, তিনি বললেন হ্যাঁ, আমি তো তাই কামনা করি। নবীজী সা: বললেন, তাহলে ভবিষ্যতে এমনটি যেন না হয়, একজনকে সবই দিয়ে দিলে আর অন্যদেরকে বঞ্চিত রাখলে।’ অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘আমার পিতা আমাকে একটি হাদিয়া দিলেন, কিন্তু আমার মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম যতক্ষণ আপনি রাসূল সা:-কে এ ব্যাপারে সাক্ষী না রাখবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার এ হাদিয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না, তখন পিতা রাসূল সা:-এর কাছে গিয়ে বললেন, আমি আমরাহ বিনতে রাওয়াহা-এর গর্ভজাত সন্তান, আমার পুত্র নোমানকে কিছু হাদিয়া দিয়েছি, এতে আমার স্ত্রী আমরাহ বলেছে, আমি যেন এ ব্যাপারে আপনাকে সাক্ষী রাখি, রাসূল সা: বললেন, তুমি তোমার সব সন্তানকে কি এ রকম হাদিয়া দিয়েছ, তিনি বললেন না তো! রাসূল সা: বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং সব সন্তানের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করো, ফলে পিতা বাড়ি ফিরে আমাকে দেয়া হাদিয়াটি ফিরিয়ে নিলেন।’ (বুখারি)
উপরিউক্ত হাদিসে প্রতীয়মান হয়, সন্তানদের মধ্যে অসম আচরণ; কাউকে সব কিছু দিয়ে দেয়া আর কাউকে বঞ্চিত করা নিষেধ এবং এমন আচরণকে জুলুম তথা বেইনসাফি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কয়েকজন ইমাম এমন আচরণকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন।
হজরত আনাস রা: বলেন, রাসূল সা:-এর কাছে এক লোক বসা ছিল, কিছুক্ষণ পর তার পুত্রসন্তান কাছে এলো, সে তাকে কাছে নিয়ে চুমু দিলো এবং স্বীয় রানের ওপর বসাল, কিছুক্ষণ পর তার কন্যা সন্তানটিও এলো, কিন্তু তাকে একপাশে বসিয়ে রাখল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সা: লোকটিকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘কেনো ইনসাফ করলে না।’ (তাহাবি ১/২০৪)
সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, বরং এ জন্য কঠিন জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। রাসূল সা: বলেন, ‘শুনো! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, তত্ত্বাবধায়ক এবং প্রত্যেককেই তার অধীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, আল্লাহ পাক আমাদের সন্তানদের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা ও ইনসাফ অবলম্বন করে পক্ষপাতমূলক আচরণ পরিহার করার তৌফিক দিন। আমিন। লেখক : মুহাদ্দিস, মারকাজুল ফিকহিল ইসলামী, উত্তরা, ঢাকা।