রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৪ অপরাহ্ন

আবুল হাসান: জীবনে ও কবিতায়

খবরপত্র ডেক্স:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন ফরিদপুর জেলার টুঙ্গীপাড়ার বর্নি গ্রামে নানার বাড়িতে কবি আবুল হাসান জন্মগ্রহণ করেন। বর্নি গ্রাম তাঁর ভীষণ প্রিয়- যার প্রমাণ আমরা ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ কবিতায় দেখতে পাই। আবুল হাসানের প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া, পরবর্তীতে আবুল হাসান নামে কবি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘টুকু’। ১৯৫৩ সালে বর্নি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তারপর ‘ছিল্না-গুয়াদানা’ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। বাবার চাকরির সুবাদে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। আরমানিটোলা স্কুলে পড়ালেখার সময় থেকেই আবুল হাসান নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন। ১৯৬৩ তে এস.এস.সি, ১৯৬৫ সালে তিনি ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয় থেকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
১৯৬৫ সালে আবুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জন সম্পন্ন করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই হাসান সাহিত্যচর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি ঢাকার তরুণ কবিদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন এবং আস্তে আস্তে পদার্পণ করেন ‘উদ্বাস্তু-উন্মুল’ যৌবনে। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলে আবুল হাসান অর্থের প্রয়োজনে পত্রিকায় চাকুরি নেয়ার কথা ভাবেন। ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে তিনি দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় বার্তা বিভাগে সাংবাদিকতা শুরু করেন। কিন্তু মাত্র তিন মাস পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। কোন পত্রিকাতেই তিনি একটানা বেশি দিন কাজ করেন নি।
১৯৭২ সালের প্রথম দিকে আবুল হাসান ‘গণবাংলা’ পত্রিকায় যোগ দেন। ‘গণবাংলা’-য় তখন সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন কবি শহীদ কাদরী। সাহিত্য বিভাগে শহীদ কাদরীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ‘গণবাংলা’-য় তিনি কর্মরত ছিলেন। তারপর তিনি যোগ দেন আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক ‘জনপদ’ পত্রিকায়। ‘জনপদ’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। এ পত্রিকায় প্রথম দিন থেকেই আবুল হাসান সহকারী সম্পাদকের দায?িত্ব গ্রহণ করেন। ‘জনপদ’ পত্রিকায় তিনি ১৯৭৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাহিত্য সম্পদনা করেন। এই দেড় বছরে ‘জনপদ’ পত্রিকায় আবুল হাসানের অনেক রচনা প্রকাশিত হয়েছে-এর মধ্যে আছে কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ। এই পত্রিকায় তিনি ‘আপন ছায়া’ এবং ‘খোলাশব্দে কেনাকাটা’ শীর্ষক দুটি উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন। ‘খোলাশব্দে কেনাকাটা’ শীর্ষক কলামটির প্রথম চার সংখ্যা তিনি ‘ভ্রামণিক’ ছদ্মনামে লিখেছেন। ১৯৭৪ সালের জুন মাসের শেষের দিকে আবুল হাসান ‘জনপদ’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সহ-সম্পাদক হিসেবে দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় যোগ দেন। কবি আল মাহমুদ-সম্পাদিত ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় আবুল হাসান ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় তিনি ‘আড়ালে অন্তরালে’ এবং ‘বৈরী বর্তমান’ শীর্ষক দুটি উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন। এছাড়া ‘ফসলবিলাসী হাওয়ার জন্য কিছু ধান চাই’ শীর্ষক একটি উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা করে সেই সময় তিনি লেখক হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৭০ সালটি আবুল হাসানের জীবনে বিশেষ তাৎপর্যবহ। কারণ ‘শিকারী লোকটা’ শিরোনামে একটি কবিতার জন্য এ সময় তিনি সমগ্র এশিয়াভিত্তিক এক প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অর্জন করে বিশেষ পুরষ্কার লাভ করেন। পরে ওই কবিতাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের কবিতা-সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭০) শীর্ষক ওই গ্রন্থে তদানীন্তন পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি আবুল হাসানের কবিতা স্থান পায়।
আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আবুল হাসানের কবি খ্যাতি বিস্তার লাভ করে। এরপর অসুস্থতার বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রামী আবুল হাসানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’ প্রকাশ করে ঢাকার প্রগতি প্রকাশনী ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আবুল হাসান তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’র পা-ুলিপি তৈরি থেকে শুরু করে প্রুফ দেখা সবটাই করেছেন। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে ‘পৃথক পালঙ্ক’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯৮৫ সালে নওরোজ সাহিত্য সংসদ প্রকাশ করে ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা’। মূলত কবি হলেও আবুল হাসান বেশ কিছু সার্থক ছোটগল্প রচনা করেছেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ঢাকায় বিভিন্ন দৈনিক ও সাময?িকপত্রে তাঁর গল্প প্রকাশিত হতে থাকে। তবে জীবিত অবস্থায় তাঁর কোন গল্প-সঙ্কলন প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পনের বছর পর ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর নয়টি গল্পের সঙ্কলন ‘আবুল হাসান গল্পসংগ্রহ’। কবিতা-গল্প ছাড়াও আবুল হাসান প্রবন্ধ এবং নাটক রচনা করেছেন। ‘ওরা কয়েকজন’ শীর্ষক একটি কাব্যনাটক তাঁর মৃত্যুর পর সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’-য় (১২.১২.১৯৭৫) প্রকাশিত হয়, যা স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয় ১৯৮৮ সালে। জার্মানি থেকে ফিরে এসে আবুল হাসান ‘কুক্কুরধাম’ নামে একটি বৃহৎ কাব্য রচনার পরিকল্পনা করেন। এর বেশ কিছু অংশ তিনি রচনাও করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি তা আর শেষ করতে পারেননি। আবুল হাসান সেকালের স্বভাব-কবির মতো অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একটি তরতাজা কবিতা লিখে দেয়ার মতো বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
শৈশব থেকেই আবুল হাসান বাত-জ্বরের রোগী ছিলেন। কখনো সুচিকিৎসা হয়নি বলে যৌবনে পদার্পনের পূর্বেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর হৃদপি- সম্প্রসারণজনিত ব্যাধি প্রথম ধরা পড়ে ১৯৭০ সালে। ওই সময় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে মুক্তিলাভের পর অনিয়ন্ত্রিত জীবন, অনিয়মিত খাওয়া, অমানুষিক পরিশ্রম এবং রাত জাগার অভ্যাস আবুল হাসানকে দ্রুত হৃদরোগে জর্জরিত করে তোলে। দিন দিন তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি পুনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরো বেশি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে শারীরিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে তাঁকে ভর্তি করা হয় ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। কিন্তু আরোগ্যলাভের কোন লক্ষণ দেখা না দেয়ায় তাঁকে পি.জি. হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এখানেও আরোগ্যলাভের কোন সম্ভাবনা দেখা না দেয়ায় চিকিৎসকরা তাঁকে বিদেশে যাবার পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় কয়েকজন বন্ধুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তাঁকে চিকিৎসার জন্য পূর্ব জার্মানি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশ এবং পূর্ব জার্মানির মধ্যে সম্পাদিত সাংস্কৃতিক চুক্তির শর্তানুযায়ী পূর্ব জার্মান সরকারের অর্থানুকূল্যে আবুল হাসানকে খুব দ্রুত পূর্ব জার্মানি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর আবুল হাসান খানিকটা সুস্থ হয়ে হয়ে ওঠেন এবং হাসপাতালের বেডে শুয়েই তিনি আবার কবিতা লিখতে শুরু করেন। কখনো কখনো তিনি হাসপাতালের অদূরে গ্রীষ্মনিবাসে বেড়াতেও যেতেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে শিল্পী গ্যাব্রিয়েলার সঙ্গে। গ্যাব্রিয়েলার সঙ্গে তিনি বার্লিনের বহু জায়গায় ঘুরেছেন এবং একাধিকবার শহরতলীতে অবস্থিত গ্যাব্রিয়েলার বাসায় বেড়াতেও গেছেন। ১৯৭৫ সালের শুরুতেই আবুল হাসান পুনরায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জার্মান ডাক্তাররা তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে তাঁকে চেকোস্লোভাকিয়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাঁর হৃৎপি- ততদিনে প্রায়-অকেজো হয়ে গেছে, যা সারিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন জটিল অস্ত্রোপচার। এ সময় বার্লিনস্থ এ.পি.এন.-এর সংবাদদাতা ভারতীয় নাগরিক প্রকৌশলী সুনীল দাশগুপ্ত এবং তাঁর জার্মান বংশোদ্ভুতা পতœী বারবারা দাশগুপ্তের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আবুল হাসানকে চেকোস্লোভাকিয়া বা অন্য কোন দেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু জটিল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকার জন্য সে দেশের চিকিৎসকরা অপারেশনের ঝুঁকি নিতে চাননি। এই জটিল পরিস্থিতিতে বার্লিনস্থ চ্যারিটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ আবুল হাসানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আবুল হাসান চ্যারিটি হাসপাতাল থেকে
মুক্তিলাভ করে সপ্তাহখানেক তাঁর জার্মান-বান্ধবী গ্যাব্রিয়েলার বাসায় ছিলেন। তারপর ১৯৭৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে বার্লিন ত্যাগ করেন।
১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা পৌঁছে আবুল হাসান তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাসানের সাময়িক সুস্থতা দেখে তাঁর বন্ধুরা কিছুটা আশ্বস্ত হন। এ অবস্থায় আবুল হাসান চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন। অনেকেই তাঁকে আশ্বাস দেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই তা রক্ষা করেননি। হাসানের অসুস্থতার কথা বিবেচনা করেই কেউ তাঁকে চাকুরি দেননি, কেননা, তাহলে পরিশ্রমজনিত ক্লান্তিতে তাঁর অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পাবে- এই ছিল তাঁদের ধারণা। এ সময় চাকুরির সন্ধানে তিনি একবার বরিশাল শহরেও যান, কিন্তু ওখানেও কোনো সুবিধা হয়নি। একদিকে অসুস্থতা, অন্যদিকে বেকার-জীবন মাথার ওপর ভাই-বোনদের পড়ালেখার খরচ যোগানোর দায?িত্ব- সব কিছু মিলিয়ে আবুল হাসান তখন এক অস্থির জীবন যাপন করেছেন। ক্রমে তিনি পুনরায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে পি.জি. হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পি.জি. হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর। হাসপতালের বেডে শুয়ে বুকের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর মাত্র আটাশ বছর বয়সে আবুল হাসান মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে তাঁর নামাজে-জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর তাঁর মরদেহ ঢাকার বনানী গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পর তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। স্বল্প-পরিসর জীবনে মাত্র দশ বছরের সাহিত্য-সাধনায় আবুল হাসান নির্মাণ করেছেন এক ঐশ্বর্যময় সৃষ্টিসম্ভার, যার ভিতর দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। তিনি তাঁর স্বল্প সময়ে সাহিত্যের অনেক শাখা প্রশাখায় বিচরণ করেছেন। খোঁজার চেষ্টা করেছেন শান্তি, শিল্প এমনকি নিজেকেও। আমরা যারা তাঁর পাঠক, আমরাও আমাদের মতো করেই তাঁর কবি পরিচয় খুঁজে বের করতে চাই। তাঁর ‘পৃথক পালঙ্ক’ কাব্যগ্রন্থের ‘ঝিনুক নীরবে
সহো’ কবিতাটি, কবির পরিচয় এই কবিতা দিয়েই শুরু করা যাক।
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও,
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!
এ কোন ঝিনুক যে নিরবে সহে যায়, শুধুই নিরবে সহে যায় আর মুক্তা ফলায়?
কার জন্য ঐ মুক্তা, কেনই-বা ঝিনুক মুক্তা ফলাবে? এই প্রশ্নগুলো কবির মনে
কিভাবে দাগ কেটেছিল, কিংবা আদতেই দাগ কেটেছিল কিনা? নাকি দাগ
কেটে- ক্ষতও সৃষ্টি করেছিলো? তিনি কি খনি শ্রমিককে দেখতে পাননি? নাকি তিনি মনির পূজারী? এক নাদান পাঠক হিসেবে এই প্রশ্নগুলো অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। পাঠক মনেমনে উত্তর খুঁজে নেয়। এই দুনিয়ায় খনি শ্রমিকের চেয়ে মণিমুক্তোর কারিগর এবং তারও বেশি মণির মালিকের মূল্য বেশি। কবি আবুল হাসান নিজেও এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করেছেন। আজো আমরা দেখি এই সমাজের প্রান্তজন যারা তারা ঝিনুকের মতোই তাঁর শ্রমকে বালির মতো আঁকড়ে ধরে সমাজের জন্য ফসলের মুক্তাদানা উৎপাদন করে যায়। ওরা কথা বলে না, নিরবে সহে যায়। নিরবে ফসল ফলায়। কবি কি এখানে সেই বেদনার্ত নিরবতার কথাই লিখলেন? নাকি তাঁর গলায় আক্ষেপের সুর? আবুল হাসানকে পাঠ করতে গিয়ে আরো আরো প্রশ্ন, আরো আরো জীবনবোধ নাড়া দিয়ে যায় আবলীলায়।
আবুল হাসান তাঁর নিজের পরিচয় নিজেই দিয়ে গেছেন, নিজেকে নিয়ে লেখা ‘আবুল হাসান’ কবিতায়। সে কবিতায় তিনি নিজেকে একইসাথে পাথর, নদী, উপগ্রহ, রাজা, কান্না ভেজা চোখ, মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারাÍ আবার তিনি নিজেই সংশয় প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘কি অর্থ বহন করে এইসব মিলিত অক্ষর?’ তিনি নিজে কি ছিলেন, তা নিজে কিভাবে বুঝেছেন সেটা তাঁর কবিতার অবাক পাঠক না জানলেও তাঁর কবিতার পঙ্?ক্তি পাঠককে কবি আবুল হাসান সম্পর্কে অনেক ধারণাই দেয়। কখনো কখনো মনে হয় তিনি স্বীকৃতির অভাবে কাতর, শুধু তাঁর নিজের নয় বটে। ‘আমি আমার আলো হবার স্বীকৃতি চাই, অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই’- ‘স্বীকৃতি চাই’ কবিতায় তিনি এভাবেই আকুতি জানিয়েছেন। পাঠকের মনে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কে বা কী কবির আলো কিংবা আঁধারের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। হয়তো এই উত্তর ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না’- পঙ্ক্তির মধ্যে কবি নিজেই পেয়েছেন। কী এই জাতিসংঘ, কারা তা বানায়। সে প্রশ্ন কবিকে ভাবিয়েছে বটে। তাইতো কবির উষ্মা প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর ‘অসভ্য দর্শন’ কবিতায়। এই কবিতায় তিনি রাজনীতিকে প্রশ্ন করেছেন চাঁছাছোলা ভাবেই। সেই প্রশ্ন ঠিক অনেকাংশেই। কিন্তু এই অসভ্য দর্শনের রাজনীতির পাল্টা রাজনীতির পথ কি কবি দেখিয়েছেন? কিংবা দেখিয়েছেন কি অন্য কোন পথ, যা শান্তির, শিল্পের? কবি আবুল হাসান শান্তি কিংবা শিল্পের পথ দেখান নাই হয়তো, তবে তিনি ‘স্বাতীর সাথে এক সকাল’ কবিতায় নিজেকে দাবি করেছেন, ‘আমি শান্তি আর শিল্পের মানুষ’। পাঠক কিন্তু আবার প্রশ্নের মধ্যে! কবি কোন শিল্পের মানুষ? ‘শিল্প এখন সুবিধাবাদ’ এটা তো তাঁরই কথা ‘প্রত্যাবর্তনের সময়’ কবিতায়। শিল্প যদি এখন সুবিধাবাদ হয় তা ভাঙতে হবে ধাক্কা মেরেই। জাতিসংঘ যদি নিতে না চায়, মৃত্যু দিয়েই ঘেরাও করতে হবে জাতিসংঘকে। ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানের আক্ষেপ নিশ্চয় ঝিনুককে প্রতিরোধী বানাবে। খনিক শ্রমিকের আজ জরুরি মণিমুক্তার কারিগরের চেয়ে, উৎপাদক আজ জরুরি ভোক্তার চেয়ে, ঝিনুক আজ জরুরি মুক্তার চেয়ে। কারণ মা নিশ্চয় সন্তানের পরে নয়! আবুল হাসানের সাহিত্যকর্ম সেই জীবনবোধেরই শিক্ষা দিতে চেয়েছে। আবুল হাসান মানুষ, আমরাও মানুষ (অন্তত জৈবিকভাবে)।. ঠিক একই ভাবে সমাজের বিপুল অধিকাংশ ব্রাত্যজনও মানুষ। আর মানুষের মাতৃভাষা কি, তা আবুল হাসান তাঁর ‘মাতৃভাষা’ কবিতায় বলেছেন স্পষ্ট করেই-
‘শুধু আমি জানি
আমি একটি মানুষ,
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com