জগৎ, জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে মহান প্রভুর নির্ভুল হিসাব-নিকাশের কী বিস্ময়কর লীলা। পৃথিবী নামক গ্রহে মানবসভ্যতার উন্মেষকালে বসবাসের অযোগ্যসহ পিছিয়েছিল যেসর দেশ সেসব দেশে আজ শান্তির সুবাতাসসহ এগিয়ে চলছে হুহু করে। ইউরোপের সর্বোত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে এই তিন দেশের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। আধুনিক বিশ্বের কাছে আদিম স্বভাবের এই তিন দেশ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের নাম স্ক্যান্ডিনেভিয়া। শীতপ্রধান স্ক্যান্ডিনেভিয়া, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও ফ্যারো (ঋধৎড়ব) দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে নরডিক অঞ্চল। নরডিক অঞ্চল তীব্র শীতের কারণে বসবাসের অযোগ্য হওয়ায় অনেকে নরডিক এলাকা ছেড়ে পদব্রজে, ভ্যারাঙ্গিয়ান (ব্রতী পুরুষ) ও জলপথে ভাইকিংরা বাসযোগ্য ভূমির সন্ধানে বের হয়ে পড়ত। বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে আবাসন গড়ে তুলত পাশ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে। ভাইকিংদের ভয়ে আতঙ্কিত ছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ। পোলার আইস ক্যাপে আচ্ছাদিত ছিল নরডিক এলাকার উত্তরাংশ। সূর্য থেকে যে তাপ পাওয়া যেত সে তাপ বরফের ঠা-া কাটিয়ে মনুষ্যবাসের উপযোগী ছিল না। এক সময় নাটকীয়ভাগে বরফ গলতে শুরু করে। বরফ গলে বের হতে শুরু করে পাথর আর হ্রদ। পাথরের ফাঁকফোকর থেকে বের হয়ে আসে উদ্ভিদ।
খ্রিষ্টপূর্ব ১২,০০০ সাল থেকে এখানে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৮,০০০ থেকে ৬,০০০ প্রস্তর যুগে। পাথরকে হাতিয়ার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। বেঁচে থাকতে শিকার, মাছ ধরার সরঞ্জাম ও অস্ত্র তৈরির জন্য পাথর ব্যবহার করত। বসবাস ও জীবনধারণের অনুপযোগী দেশটি সোজা হওয়া শুরু করতে শুরু হয় আত্মকলহ। হাজার বছর কলহ-বিবাদের পর সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে অশান্তির দেশে শান্তির সূর্যোদয় শুরু। ১৮৩৩ সালে আলফ্রেড নোবেলের জন্ম। গবেষণার রত্মগর্ভা সুইডেন একের পর এক জন্ম দেয় গবেষক। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্বস্বীকৃত গবেষণাকর্ম ও শান্ত পরিবেশের জন্য উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সুইডেন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে পিএইচডি গবেষণা করছেন। প্রতি বছর ‘সুখ-শান্তির দেশ’ তালিকায়ও নরডিকদের নাম শীর্ষে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানীখ্যাতিও লাভ করেছে নরডিকরা। বিশ্বের পুঁজিবাদী পরাশক্তিও নরডিক অঞ্চলের সমর্থন ও সহানুভূতিপ্রার্থী। আজ উষ্ণম-লের লোক নরডিকের শীতম-লে দর্শনসহ আশ্রয় নিতে পাগলপারা। সুইডেন যাওয়ার জন্য জন্য মুখিয়ে ছিলাম আমিও। মেয়ে মল্লিকা ও মেয়েজামাই নাঈম সুইডেনবাসী। নাঈম একবার একটি আপেল গাছের ছবি পাঠিয়েছিল। গাছ ভর্তি পাকা আপেল। ভূমিতে ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে অসংখ্য আপেল। গাছ থেকে আপেল পাড়লেও কেউ কিছু বলে না। সুইডেন গিয়ে সেই গাছটি দেখতে চেয়েছিলাম। গত ১৮ এপ্রিল ২০২২ সেই গাছটির কাছে নিয়ে গিয়েছিল নাঈম। বাম দিকের মাঠে বজ্রপাতে পুড়ে যাওয়া মরা গাছের মতো একটি গাছ দেখিয়ে নাঈম বলে-
-আব্বা, এই সেই আপেল গাছ। শীত কমতে শুরু করেছে। ডালপালা ফেটে বের হতে শুরু করেছে পাতা। দেড়-দু’মাসের মধ্যেই ফুল-পাতায় ছেয়ে যাবে গাছ। বিপরীত পাশে বড় এক মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটি পাথর। হাঁটতে হাঁটতে যাই পাথরের কাছে। কাছে গিয়ে দেখি, পাথরের গায়ে একটি পুরো ব্রোঞ্জপত্র। পাত্রে খোদাই করে সিংহের মূর্তিসহ (ঝুসনড়ষ ড়ভ ঝবিফবহ) সুইডিশ ভাষায় কিসব লেখা। সুইডিশ ভাষা ও শব্দ অনেকটা ইংরেজি ভাষা ও শব্দের মতো। পাত্রের ভাষা ইংরেজি অক্ষরে,’SOLDIERS FROM SMALAND WERE PRACTICE HERE UNDER KUNGL. KRONOBERG REGEMENT ‘S BAGS IN THE YEARS 1623 – 1778 AND 1915-1992’ এই পাথরটি প্রাক্তন রেজিমেন্টের ফুটবল মাঠে আবিষ্কৃত হয়। পাথরটির গা ঘেষে দাঁড়াতেই নাঈম ছবি নিতে নিতে বলে-
-আব্বা, আমরা যে এলাকায় আছি সে এলাকার নাম ভক্সজো। ভক্সজো ক্রনোবার্গের রাজধানী। ক্রনোবার্গ স্মাল্যান্ড প্রদেশের একটি কাউন্ট্রি। স্মাল্যান্ড সুউডেনের একটি প্রদেশ। সত্যি কথা বলতে কি, কাউন্ট্রি, বিভাগ আর প্রদেশ নিয়ে আমরাও গোলকধাঁধায় আছি। কখনো কখনো কাউন্ট্রি আর প্রদেশে কোনো পার্থক্য নেই। ১৬৩৪ সাল পর্যন্ত সুইডেনের প্রদেশগুলো বিভাগ হিসেবে স্বীকৃত হতো। এরপর সুইডেনকে কাউন্ট্রিতে ভাগ করা হয়। সুইডেনের উত্তর-পূর্বে ফিনল্যান্ড, পশ্চিমে নরওয়ে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ওরেসুন্ড ব্রিজ। রাজধানী স্টকহোম। আয়তন চার লাখ ৫০ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। এটি ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে এক কোটি চার লাখ লোকের বাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ২৫ জন লোক বাস করে। জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ শতাংশ বাস করে শহরে। রাষ্ট্রভাষা সুয়েডীয়। মুদ্রার নাম ক্রোনা। ক্রোনার ডান পাশে একটি শূন্য যোগ করলে বাংলাদেশী মুদ্রার সমান হয়।
সাইকেল : পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যকর এবং সাশ্রয়ী; সব দিক দিয়ে বাহন হিসেবে এগিয়ে রয়েছে সাইকেল। ইউরোপের সেসব দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন সাইকেল। কোপেনহেগেন, আমস্টার্ডাম, প্যারিস, মালমোতে সাইকেলের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। আমরা মনে করি, এখানকার মানুষের প্রধান বাহন সাইকেল। দূরপাল্লা ছাড়া নারী-পুরুষ সবাই সাইকেল ব্যবহার করে। বাড়িতে নামী-দামি গাড়ি থাকতেও সাইকেলই প্রিয় বাহন। সাইকেলের রাস্তা আলাদা। যেখানে প্রধান রাস্তা ক্রস করতে হয় সেখানেও সাইকেল স্বাধীন। চলন্ত বাস ও ট্যাক্সি থেমে যায় সাইকেল রোডে সাইকেল দেখলে। সব বয়সী নারী-পুরুষ সাইকেল চালায়। এক কথায় সাইকেলের স্বর্গরাজ্য সুইডেন। এ দেশের মানুষের সুখ-শান্তির সূচনা সাইকেল থেকে। প্রথমত, সাইকেল পরিবেশবান্ধব। দ্বিতীয়ত, সাইকেল চালানো উত্তম ব্যায়াম। তৃতীয়ত, আরামদায়ক। চতুর্থত, সাশ্রয়ী। পরিশেষে বলা যায়, বহনসহ সহজে রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য। দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারে গাড়ি থাকা সত্ত্বে ও তারা সাইকেল চড়ে বিদ্যালয়ে যায়। আমি মেয়ের বাসায় যে এলাকায় উঠেছি, এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রত্যেক অফিস আদালতসহ বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে সাইকেল পার্কিংয়ের জন্য আলাদা স্থান। শত শত শিক্ষার্থী সাইকেলে চড়ে ক্লাস করে। আমর মনে হয়েছে, সুখের প্রথম কারণ পরিবেশবান্ধব সাইকেল।দ্বিতীয়ত, রিসাইক্লিং‘WTF’ পদ্ধতি, যার অর্থ ডধংঃব ঃড় বহবৎমু. আবর্জনা থেকে শক্তি। সুইডেনে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পের আবর্জনা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সুইডেনে এ ধরনের ৩২টি প্লান্ট রয়েছে। সুইডেনের প্রথম নজর- পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দিকে। এখানে পরিবেশ নষ্টকারী বর্জ্য বলতে কিছু নেই। রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে সমাজের সব ত্যাজ্য দ্রব্য ও বর্জ্য ব্যবহার-উপযোগী হয়ে পুনরায় ফিরে আসে সমাজে। প্রাণী দেহের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বর্জ্য দিয়ে তৈরি হয় বায়ুগ্যাস। মার্সিডিজ কোম্পানির বাসগুলোও বায়ুগ্যাসে চলে। গ্যাস তৈরির জন্য কোনো এক সময় সুইডেনে ময়লা-আবর্জনার সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
সামাজিক গণতন্ত্রের দেশ সুইডেন
এখানে অস্বাভাবিক ধনী ও অস্বাভাবিক নির্ধন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো সরকারেরও সুযোগ নেই সামাজিক গণতন্ত্রের বাইরে যাওয়ার। বিশ্বের সর্বোচ্চ আয়কর গ্রহণকারী দেশ সুইডেন। উন্নত জীবন আর ভালো উপার্জনের দেশও সুইডেন। যারা অস্বাভাবিক আয় করেন তাদের আয়করও অনেক বেশি। ভালো উপার্জনের পাশাপাশি মাসশেষে মোট আয় থেকে পরিশোধিত করের পরিমাণ ২০-৫০ পার হয়ে কখনো কখনো সাকুল্যে পৌঁছে যায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। শুধু সুইডেন নয়, ইউরোপের অর্থনীতির মূল উৎস ট্যাক্স। একজন মধ্য আয়ের লোক সরকারকে কি পরিমাণ ট্যাক্স দেয় তা নিচের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। ধরে নেয়া যাক, রহিম বাংলাদেশী। চাকরি করেন সুইডেনে। তিনি মাসে বেতন পান ৩০ হাজার ক্রোনা। তিনি যখন বেতন ড্র করেন; তখন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান তার নামে সরকারকে ট্যাক্স দিয়েছে ৩১ শতাংশ অর্থাৎ ৯ হাজার ৫০০ ক্রোনা (এ ট্যাক্স পেনশন ও ইন্স্যুরেন্স কভার করে)। রহিম ৩০ হাজার বেতন পেলেও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তার বেতন ছিল ৩৯ হাজার ৫০০ ক্রোনা। রহিম বেতন হাতে পাওয়ার আগে কমিউনাল ট্যাক্স বা পৌরকর কেটে নেয়া হয় যা এক পৌর এলাকা থেকে আরেক পৌর এলাকায় সামান্য পার্থক্য আছে। তবে গড়পড়তায় ৩২ শতাংশ অর্থাৎ রহিমের বেতন ৩০ হাজার টাকা হলেও ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে দেখবেন জমা হয়েছে ২৩ হাজার ৫০০ ক্রোনা।
যে টাকা রহিম তার অ্যাকাউন্টে পেয়েছে তার থেকে তাকে আবার অন্যান্য ক্রয়ের ট্যাক্স ও ভ্যাট দিতে হবে।, যা আনুমানিক ৫ শতাংশের ১ শতাংশ, রহিমের বেলায় আনুমানিক চার হাজার ৫০০ ক্রোনা। অর্থাৎ কাজ করে একান্ত নিজের করে পেয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ক্রোনা। মোট হিসাবটা চাকরিদাতার ট্যাক্সসহ হিসাব করে দেখলে দেখা যায়, রহিম কাজ করে যা পায় তার থেকে তার নিজে রাখতে পারে ৪৮ শতাংশ ও সরকারের ঘরে যায় ৫২ শতাংশ।
এত ট্যাক্স দিলে নাগরিক সুবিধা না দিয়ে কারো বাপের ক্ষমতা আছে ক্ষমতায় বসে থাকবে? গণতান্ত্রিক অধিকারে সেটি বন্ধ রাখার ক্ষমতা কি কারো থাকার সম্ভাবনা আছে? ইউরোপকে স্বর্গ মনে করার আগে একবার হিসাবটা দেখুন, সেই স্বর্গের মূল্য কত? তারা মনে করে, পরিমিত পরিমাণের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ শরীরের অতিরিক্ত চর্বির মতো ভয়ঙ্কর। তৎসঙ্গে যুক্ত হয়েছে, উন্নতমানের শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবাসহ আয় ও ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে বছর শেষে আয়করের একটি অংশ ফেরতও পাওয়া যায়। স্থিতিশীল রাজনীতি। সুইডেনে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত। রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাফ এখানকার রাষ্ট্রপ্রধান। তবে বহুদিন ধরে রাজার ক্ষমতা শুধু আনুষ্ঠানিক কাজকর্মে সীমাবদ্ধ। সুইডেনের আইনসভার নাম ‘রিক্সদাগ’। আইনসভার সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। প্রতি চার বছর অন্তর সেপ্টেম্বরের তৃতীয় রোববারে আইনসভা নির্বাচন হয়। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’ গণতন্ত্র সূচকে সুইডেনকে ১৬৭টি দেশের মধ্যে সবার উপরের দিকে রেখেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ২০১৪ সালে প্রকাশিত বিশ্ব সাংবাদিক স্বাধীনতা সূচকে সুইডেনকে ১৬৯টি দেশের মধ্যে দশম স্থান দেয়। এ ছাড়া দেশটিই জীবনযাত্রার মান, প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল, শিক্ষার হার, শান্তি ও অগ্রগতি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুযোগ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রসরমান। -সুইডেনের ইতিহাসের শুরুতে পাই আত্মকলহ ও যুদ্ধ। পশ্চিমে নরওয়ে বলতে গেলে আর তিন দিকে সাগর। জানতে ইচ্ছে করছে, সুইডেনের যুদ্ধ কার সাথে?
-ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানভুক্ত এই তিন দেশের আত্মকলহ চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী। পরিশেষে রূপ নেয় যুদ্ধে। যুদ্ধে সবেচেয়ে আক্রান্ত হয় দক্ষিণাঞ্চল। অর্থাৎ আমরা যে এলাকায় থাকি সে এলাকা। যুদ্ধ হয়েছিল ড্যানিশদের সাথে। এ এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ড্যানিশদের হাতে। ড্যানিশদের সাথে ডজনখানেক যুদ্ধসহ দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দর স্থানটি কতবার ‘জ্বালাও-পোড়াও’সহ বিধ্বস্ত হয়েছে লেখাজোখা নেই। সুইডেনের এই ৮০০ বছরের ইতিহাস খুব হৃদয়বিদারক। ১৬৫৮ সালে ড্যানিশ ও সুইডিসের মধ্যে রোসকিল্ড চুক্তি স্বাক্ষরে ৮০০ বছর সময়কাল পর্যন্ত সুইডেনকে দুঃখের দরিয়া সাঁতরাতে হয়েছিল। দুঃখের দরিয়া সাঁতরাতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে, ‘নশ্বর জীবন, অশান্তি আর কলহ-বিবাদ নয়। সুখে-শান্তিতে কিভাবে বাঁচা যায় তাই হচ্ছে প্রাপ্তি।’ অশান্তির আগুনে পোড়া নরডিক জাতি রিঅ্যাকটিভ নীতি পরিবর্তন করে ক্রিয়েটিভ নীতি গ্রহণ করে। হয়ে ওঠে সহনীয় ও ধৈর্যশীল দেশ। হাজার বছরের ঘাত-সঙ্ঘাতে ক্ষত-বিক্ষত সুইডেন হয়ে ওঠে ক্রিয়েটিভ আর সহনশীল। সহনশীলতার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রায় দুই শতাব্দী ধরে দুই বিশ্বযুদ্ধসহ কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। ঊনবিংশ শতক থেকে সুইডেন একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান বজায় রেখেছে এবং কোনো ধরনের যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত থেকেছে।
এ এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তখন ছাপাখানা ছিল না। সুইডেনবাসী তাদের অত্যাচারিত হওয়ার বিষয় লিখে রেখেছে সমাধিতে পাথরের গায়ে। দেশের জন্য সৈনিকসহ যে যেখানে নিহত হয়েছে সেখানে পাথরের গায়ে খোদাই করে স্মৃতিফলক বানিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। লেক-পাথরের দেশ সুইডেনের সুখ-দুঃখের সাথী পাথর। সুইডেনের দক্ষিণ এলাকা ক্রনোবার্গ। ড্যানিশদের আক্রমণ প্রতিহত করতে নির্মিত হয়েছিল পাথরের দুর্গ। দুর্গের নাম ক্রনোবার্গ দুর্গ। আমি যে এলাকায় ছিলাম সে এলাকার কাছে দুর্গটি। কবি রবীন্দ্রনাথের ভৌতিক গল্পের ক্ষুধিত পাষাণ যেভাবে হাসে, কাঁদে, কথা কয় সেভাবে এ দেশের পাষাণও হাসে-কাঁদে এবং ইতিহাসের কথা কয়। বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে সুইডেন যে পাথরের দুর্গ নির্মাণ করেছিল সেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আজো রয়েছে। সেখানে গেলে ‘অশান্তির দেশে শান্তির সূর্যোদয়’-এর দৃশ্যপট সামনে চলে আসবে। আমরা অচিরেই দুর্গ দেখতে বের হবো। (অসমাপ্ত) লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com