দিগন্ত মেশে যেথায় নীল সমুদ্রের বুকে
সেথায় হারাতে চাই, অপূর্ণতা চোখে।
সূর্যোদয়টা নতুন ভোরের, অপার্থিব সূর্যাস্ত
জীবন সুন্দর হেথায়, প্রশান্তি এক প্রস্থ…
অপার সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ভালোবেসে ভ্রমণ পিপাসুরা যার নাম দিয়েছেন ‘সাগরকন্যা’। শীতকালে বিভিন্ন অতিথি পাখি দেখা যায় এ সৈকতে। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ার মতো! আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়! এটি বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
দেশের স্থানাঙ্ক ২১ক্ক৪৯?১৬? উত্তর ৯০ক্ক০৭?১১? পূর্ব বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় মধ্যে অবস্থিত এ সাগরকন্যা। এখানে রয়েছে- মৎস্য-শিকার, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত, বৌদ্ধ মন্দির, সমুদ্রতীর, ম্যানগ্রোভ বন (ফাতরার বন- সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম দিকের সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বন, যা ‘দ্বিতীয় সুন্দরবন’ হিসেবে পরিচিত), তিন নদীর মোহনা, লেম্বুসের চর ছাড়াও অনেক দর্শনীয় স্থান।
কুয়াকাটা হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। অগণিত ভক্তরা এখানে ‘রাস পূর্ণিমা’ এবং ‘মাঘী পূর্ণিমা’ উৎসবে মিলিত হন। এই উপলক্ষে তীর্থযাত্রীরা উপসাগরে পবিত্র স্নান করেন এবং ঐতিহ্যবাহী মেলায় অংশ নেন। সমুদ্র সৈকতের পাশে অবস্থিত ১০০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি এবং দু’টি ২০০ বছরের পুরানো কূপ রয়েছে।
জানা গেছে, কুয়াকাটা নামটি আরকানদের সাথে জড়িত। এর পুরো ইতিহাসের রয়েছে আরাকানদের এদেশে আগমন নিয়ে। ‘কুয়া’ শব্দটি অর্থ ‘কূপ, মুল কূপের ধারণা থেকে কুয়া শব্দের উৎপত্তি। ধারণা করা হয়- ১৮ শতাব্দীতে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) থেকে বিতাড়িত হয়ে আরাকানরা এই অঞ্চলে এসে প্রথম বসবাস শুরু করেন। সে সময় এ এলাকায় সুপেয় (পানের জন্য যে পানি) পানির অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়ো বা কূপ খনন করেছিলেন, সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা!
গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) গণমাধ্যম মাস্টার্স ব্যাচের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফরে এসেছিলেন সাগর কন্যা কুয়াকাটায়। সফর শেষে শিক্ষার্থী উজ্জ্বল হোসাইন জানান, ঢাকা থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে বাসে রওনা দেই আমরা। পদ্মা সেতুর মূলপ্রান্ত থেকে ওপার প্রান্তে যেতে মাত্র নয় মিনিট লেগেছে। শহরে এতো সুন্দরভাবে একটা গ্রাম্য পরিবেশের ছোঁয়া লেগেছে যা দেখে অভিভূত।
তিনি আরো বলেন, কুয়াকাটায় লেম্বুস বাগান, ত্রিমোহনা, কাঁকড়ার বিচ, শুঁটকি পল্লীতে যাই আমরা। শুঁটকি পল্লীতে গিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকটি শুঁটকির দোকান রয়েছে। তারপাশে কিভাবে প্রাকৃতিকভাবে মাছ শুকানো হয় সেটি দেখলাম। এরপর আমরা সেখানে থেকে সমুদ্রের পাশ দিয়েই লেম্বুসের বাগানে গেলাম।
আরেক শিক্ষার্থী আল ইমরান জানান, হোটেলে রাত কেটে ভোর হবার আগে আমরা উঠে সূর্যোদয় দেখতে অটোরিকশা যোগে রওনা দেই। সৈকতের পার হয়ে আমাদের বহনকারী যানটি চলছিল। ভোরের সৈকতের হিমেল হাওয়া, শরীরে শীতের জানান দিচ্ছে বারবার। সেই মোহনায় পৌঁছে আমরা সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকলাম। কুয়াশার কারণে বেশ দেরি করতে হয় আমাদের। খানিকটা সময় পর পূর্ব ?দিগন্তে লাল আভার দেখা যায়। এরপর দেখা যায়, আস্তে আস্তে পৃথিবীকে উষ্ণ করতে সেই সূর্যিমামাকে। সময়ের পরমক্রমে বড় হয়ে গেল সূর্য। সূর্য ওঠার মুহূর্তটা সেই লেগেছে। আনন্দের তৃপ্তি নিতে পেরেছিলাম।
শিক্ষক ও লেখক মিকাঈল হোসেন বলেন, কুয়াকাটার সৈকতের স্থলভাগ খুবই মনোরম। সমুদ্রে সৈকত থেকে দেখা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে গাংচিল। সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে আমরা টলার করে গেলাম ফাতরার বনে। জানা গেছে, সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে ম্যানগ্রোভ বন, যার নাম ফাততার বন। সংরক্ষিত বনভূমি ফাতরার বন ইতোমধ্যে দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে। এখানে রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ফাতরা, গরান, বাইন, গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ।
স্থানীয় কয়েজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সব সময় প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা দেখা যায় সাগরকন্যার পাড়ে। তবে শীত ঘিরে ও অবকাশ কাটাতে বেশি মানুষ ছুঁটে আসে এখানে। তাদের জীবিকার অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সৈকত। সাগরকন্যার রূপ আর লীলাভূমি অবলোকন করতে আসা বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীর সাথে কথা হয়। মুসা মনির নামের এক দর্শনার্থী বলেন, কুয়াকাটা অনেকভাবে উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ খাবার মানসম্মত নয় বরং বেশি টাকা নেয় হোটেল মালিকরা। স্থানীয় ও হোটেলের কর্মকর্তারা নানা সিন্ডিকেট করে। নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে থাকে।
তবে তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, সৈকতের সঠিক রক্ষণাবেক্ষন, আবাসন ও হোটেল উন্নয়ন, রাস্তাঘাট সংস্কার ইত্যাদি কার্যক্রমের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলেই ‘সাগরকন্যা’ হবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় স্থান।