শেয়ার আমেরিকার গবেষণা প্রতিবেদন
একথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে, গণতন্ত্র একটি দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটায়। অনেক জরিপ এবং গবেষণায়ও একথার সত্যতা মিলেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, গণতন্ত্র কিভাবে একটি দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটায়? সম্প্রতি শেয়ার আমেরিকা ওয়েবসাইটের বাংলা সংস্করণে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি মতামত তুলে ধরা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, গণতন্ত্র সফল হওয়ার একটি বড় কারণ হলো এর মাধ্যমে মানুষ তার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে। তাছাড়া, গণতন্ত্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেশি খরচ করে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসমোগলু বলেন যে, যেহেতু গণতন্ত্রের কারণে সমাজের দরিদ্রতর অংশগুলো স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে তাই তাদের ভেতরের সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার ও স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার সম্ভাবনা বাড়ে।
এমআইটি-র অধ্যাপক ও ১৯৬০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়কালে ১৮৪টি দেশের বিশ্লেষণমূলক গবেষণা প্রবন্ধের সহ-লেখক অ্যাসমোগলু এর মতে, যে দেশগুলোতে গত ৭০ বছরে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, গড়ে দেশগুলোতে যেমন পর্তুগাল ও দক্ষিণ কোরিয়াতে গণতন্ত্রীকরণের দুই দশকের মধ্যে মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন ২০% বেড়েছে।
বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, গণতন্ত্রে উত্তরণের পর পর্তুগাল ও দক্ষিণ কোরিয়া কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কার করেছে যেমন দেশগুলো তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলোর সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের পর দক্ষিণ কোরিয়া সেই দেশের ইউনিয়নগুলোর উপর দমন-নিপীড়ন বন্ধ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, “গণতন্ত্রের সক্রিয়তা” বোঝা যায় যখন একজন শ্রমিক ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেন। উচ্চ মজুরি, উন্নততর সুবিধা বা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্রের দাবী পূরণে কাজ করতে পারা সকল শ্রমিকের জন্য বিজয় বয়ে আনে এবং জীবনযাত্রার মান বাড়ায়।
অন্যত্র যেমন পোল্যান্ড, চেকস্লোভাকিয়া এবং বাল্টিক দেশগুলোতে ১৯৯০ এর দশকে কমিউনিজমের পতনের পর ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরু হয়েছিল। তারা তাদের দেশে কার্যকর আইনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান করেছিল, অন্য আরো অনেক কিছুর সাথে সুনির্দিষ্টভাবে এই দু’টি পদক্ষেপের ফলে তাদের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন বেড়েছে, বলেছেন অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার ইউরেশিয়া বিভাগের প্রধান উইলিয়াম টম্পসন। “পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর চৌম্বকীয় শক্তির টান ৃ দেশগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে অনুপ্রাণিত করেছে,” উল্লেখ করে টম্পসন বলেন, ২০২১ সালে পোল্যান্ডের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৯০ এর পরিমাণ থেকে ডলারের হিসেবে বাস্তবে তিনগুণ বেড়েছে।
উদ্ভাবনের স্বাধীনতা: ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের গভর্নেন্স স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড্যারেল ওয়েস্ট বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজগুলো জনগণকে তাদের মত প্রকাশের, আইনের শাসনে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার, অনুমানযোগ্য শাসনের নিয়মগুলো প্রয়োগ করার, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন পরিচালনা করার এবং একটি স্বাধীন গণমাধ্যমকে সমর্থন করার অধিকার রক্ষা করে। ওয়েস্ট সিলিকন ভ্যালির দিকে ইঙ্গিত করে করে বলেছেন গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনকে উৎ?সাহিত করে। তিনি আরো বলেছেন, “[যুক্তরাষ্ট্রে] এমন একটা পরিবেশ আছে যা মানুষকে কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে ও অপ্রচলিত ধারণাগুলো বিকাশিত হতে দেয়, মূলত এমনভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ করে দেয় যা কর্তৃত্ববাদী সমাজগুলোতে প্রায়শ সম্ভব হয় না।”
ওয়েস্ট আরো বলেছেন যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমেরিকার উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর ফলে যে অর্থনৈতিক শক্তি তাকে বাড়িয়ে তোলে। কলেজগুলো সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ের বৃহত্তম নিয়োগদাতাদের অন্যতম যা স্থানীয় অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। এছাড়াও অনেক প্যাটেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসে, বিশেষ করে কমপিউটার চিপস, এবং ব্যবসায়িক ধারণাগুলোকে পরিচালনা করে।
ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্র: “গণতন্ত্র” শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ ডেমোস মানে মানুষ এবং ক্র্যাটোস মানে শাসন থেকে এসেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের তথ্য মতে, গণতন্ত্র প্রথম চালু হয়েছিল এথেন্সে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রাচীণ গ্রীকরা তাদের দেশে এই ধরনের সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন।
ফ্রান্সের রাজনৈতিক দার্শনিক অ্যালেক্সিস দ্য টকভিল ১৮০০ দশকের শুরুর দিকেডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা নামে একটি রচনা লিখেছিলেন যেখানে তিনি তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন যে, এই দেশের সাফল্যের পিছনে বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের অবদান রয়েছে। এই রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ওয়েস্ট বলেছেন, “তার ভাবনা মতে আমাদের তেজস্বী ও প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি শক্তি।” এমআইটির অ্যাসমোগলুর মতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সাফল্যের মধ্যে চক্রাকার সম্পর্ক রয়েছে। তারা একত্রিতভাবে যে উদ্দীপনা তৈরি করে সেটা প্রায় দুই শত বছর আগে দ্য টকভিল দেখেছিলেন। উল্লেখ্য, শেয়ার আমেরিকা ওয়েবসাইট যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য জানানোর একটি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে স্টেট ডিপার্টমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে থাকে। এখানে প্রকাশিত তথ্য সকলের জন্য উম্মুক্ত এবং যে কেউ বিনামূল্যে এই তথ্য পেতে পারেন।