ইসলাম মানুষের পূতপবিত্র জীবনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী (সা.) পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ ঘোষণা করেছেন এবং নামাজসহ একাধিক ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্তারোপ করেছে ইসলামী শরিয়ত। একাধিক আয়াত ও হাদিসে মুমিনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পবিত্র জীবনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব: পবিত্রতা দ্বিনের ভিত্তি : আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইসলাম পরিচ্ছন্ন। সুতরাং তোমরা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করো। নিশ্চয়ই জান্নাতে কেবল পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিই প্রবেশ করবে।’ (ফাইজুল কাদির, হাদিস : ৩০৬৫) অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর দ্বিনের ভিত্তি স্থাপিত।’ (মাউসুআতু আতরাফিল হাদিস আন-নাবাবি, পৃষ্ঠা. ২৯৪)
নামাজ কবুলের পূর্বশর্ত : পবিত্রতা নামাজ কবুলের পূর্বশর্ত। পবিত্র শরীর ও কাপড় ছাড়া ব্যক্তির নামাজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পবিত্রতা নামাজের চাবি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৭৬)
পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক : রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলেছেন এবং অপর হাদিসে ঈমানের অর্ধেক বলেছেন। আবু মালিক আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘… আর পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫১৯)
আল্লাহ মানুষকে পবিত্র করতে চান : ঈমান ও ইবাদতের একটি উদ্দেশ্য মানব জীবনকে পবিত্র করা। আল্লাহ বলেন, ‘…আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিতে চান না; বরং তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করতে চান। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৬)
আল্লাহ পবিত্রতা ভালোবাসেন : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সেসব মানুষের প্রশংসা করেছেন, যারা পবিত্র থাকতে পছন্দ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই আল্লাহভীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেটাই আপনার নামাজের জন্য অধিক যোগ্য। সেখানে এমন লোক রয়েছে, যারা পবিত্রতা অর্জন করতে ভালোবাসে। আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৮)
পবিত্রতা ঈমানের পরিচায়ক : পবিত্রতা মুমিন জীবনের সৌন্দর্য। মুমিন দেহ ও মনের দিক থেকে সব সময় পবিত্র থাকার চেষ্টা করবে। অপবিত্রতা থেকে নিজের দেহ-মনকে রক্ষা করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্রতা রক্ষায় মুমিনকে যতœবান হতে উদ্বুদ্ধ করে বলেছেন, ‘প্রকৃত মুমিন ছাড়া আর কেউই অজুর প্রতি যতœবান হয় না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৪৩৬)
পবিত্রতা অর্জনের চার স্তর: ইসলামে বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় পবিত্রতার ধারণা সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিকও রয়েছে। এ জন্য মহানবী (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন অজু করে, সে যেন ভালোভাবে অজু করে এবং বলে, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। হে আল্লাহ, আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং আমাকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করুন।” (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৫৫)
উল্লিখিত হাদিস থেকে বোঝা যায়, পবিত্রতার সঙ্গে ঈমান ও পাপমুক্ত জীবনেরও সম্পর্ক রয়েছে। যার প্রথম স্তর বাহ্যিক পবিত্রতা এবং সর্বোচ্চ স্তর আল্লাহর নূরে অন্তর আলোকিত করা। গবেষক আলেমরা পবিত্রতা অর্জনের চারটি স্তর বর্ণনা করেন। তাহলো: ক. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে অপবিত্র, নোংরা ও অরুচিকর বিষয় থেকে পবিত্র করা। খ. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পাপমুক্ত করা : শরীরের অঙ্গগুলোর মাধ্যমে যেসব পাপ ও অন্যায় হয় তা থেকে বিরত থাকা। গ. অন্তর পবিত্র করা : কুপ্রবৃত্তি ও মন্দ স্বভাব থেকে নিজেকে পবিত্র করা। ঘ. নিজেকে গাইরুল্লাহ মুক্ত করা : আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সব কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহান আল্লাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমেই ব্যক্তি চূড়ান্ত পবিত্রতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এই স্তরের পবিত্রতা শুধু নবী ও সিদ্দিকিনরাই লাভ করতে পারেন। এই স্তর বোঝাতে সুরা আন আমের ৯২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘বলো, আল্লাহ; অতঃপর তাদের পরিত্যাগ করো।’ (আল্লামা ফায়জুল কাশানি, আসরারুল ইবাদা, পৃষ্ঠা. ৬)
পবিত্রতা ঈমানের অংশ কেন? বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে বান্দা ধীরে ধীরে আত্মিক পবিত্রতা অর্জনের পথে এগিয়ে যায় এবং আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক দৃঢ় হয়, ফলে সে ঈমানের দাবিগুলো পূরণে সামর্থ্য লাভ করে, তাই পবিত্রতা ঈমানের অংশ।
সৃষ্টিগতভাবে মানুষের ভেতর আল্লাহ দুটি প্রবৃত্তি রেখে দিয়েছেন। সুপ্রবৃত্তি যা মানুষের আত্মায় নূর সৃষ্টি করে এবং কুপ্রবৃত্তি, যা মানুষের আত্মায় পশুত্বকে শক্তিশালী করে। মানুষ যখন পবিত্র জীবন যাপন করে, তখন তার আত্মায় নূর সৃষ্টি হয়, ফলে সে ঈমানের পথে ধাবিত হয়। আর যখন সে অপবিত্র জীবনযাপন করে, তখন তার ভেতর পশুত্ব জেগে ওঠে, ফলে সে শয়তানের অনুসারী হয়। তাই পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া নেক কাজের অন্যতম ভিত্তি, যা রুচিশীল ব্যক্তির রুচির দাবি। বিশেষত, যার মধ্যে মালাকুতি (ফেরেশতাসুলভ) নূর প্রসার লাভ করেছে। তারা অপবিত্রতা অপছন্দ করে এবং পবিত্রতা পছন্দ করে। তাতে আনন্দ ও প্রশান্তি বোধ করে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা. ১৭৩)
‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক’ হাদিসের ব্যাখ্যা—শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘এখানে ঈমান দ্বারা অন্তরের সেই অবস্থা বোঝানো হয়েছে, যা পবিত্রতা ও নম্রতার নূরের সমন্বয়ে গঠিত। …পবিত্রতা অন্তরের অন্তর্মূলে প্রভাব বিস্তার করে। তা আত্মাকে পূতপবিত্র করে, নির্মল করে এবং তাকে ফেরেশতাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। অনেক নোংরা ও নাপাক অবস্থা বিস্মৃত করে দেয়। মূলত অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যকে অজুর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, পৃষ্ঠা ১৭৪)