আমাদের সমাজে অন্যায় অপরাধ অত্যচার জুলুম অনেক বেশি বেড়ে গেছে। মানুষ ভুলে গেছে পরকাল ও জাহান্নামের আগুনকে। অন্যায় অপরাধ ও জুলুমের কারণে আগে বহু জাতিকে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছেন, ধ্বংস হওয়া বহু জাতির কথা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এসেছে। পৃথিবীতে বহু আগে সামুদ জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তাদের কথা আল-কুরআনে উল্লেখ হয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে একসময় সামুদ জাতি অর্থশালী ও শক্তিশালী ছিল। তাদের সুখ-শান্তি কোনো কিছুর কমতি ছিল না, তারা বড় বড় প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে দালানকোঠা নির্মাণ করত। তারা শিল্প ও নকশা করে পাথর দিয়ে খুব সুন্দর করে প্রাসাদ নির্মাণ করত। কিন্তু তারা মহান সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়ে শুরু করে দিয়েছিল পাথর পূজা, মূর্তির পূজা ও দেব-দেবীর পূজা, তাদের মধ্যে বেড়ে গিয়েছিল অন্যায় অপরাধ ও জুলুম নির্যাতন। আদ জাতি ধ্বংস হওয়ার ৫০০ বছর পরে এই পথভ্রষ্ট সামুদ জাতিকে আসমানি ধর্ম পালন করার জন্য আল্লাহ তায়ালা একজন তাঁর মনোনীত নবী পাঠিয়েছেন হজরত সালেহ আ:-কে। আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘আমি সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো; কিন্তু তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলো।’ (সূরা নামল-৪৫) হজরত সালেহ আ: সামুদ জাতিকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তারা কোনোভাবেই তাদের নবীর কথা শুনল না ও মানল না। অল্প কিছু লোক ঈমান আনে, আর কেউ ঈমান আনেনি। হজরত সালেহ আ: তাদেরকে বারবার আসমানি ধর্মের প্রতি দাওয়াত দেন ও বোঝানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে হজরত সালেহ আ:-এর আহ্বানের জবাবে তারা বলল, তুমি আমাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া আর অন্য কিছুই নও এবং মানুষ কখনো নবী-রাসূল হতে পারে না। অতএব তুমি কোনো না কোনো একটি মোজেজা দেখাও, যদি তুমি সত্যবাদী থাকো। হজরত সালেহ আ: বললেন, তোমরা কী ধরনের মোজেজা দেখতে চাও? তারা বলল, ওই পাহাড়টির মধ্য থেকে একটি উটনী বের হয়ে আসবে আর তা তখনই একটি বাচ্চা প্রসব করবে এবং রীতিমতো তাকে দুগ্ধপান করাবে। এরূপ ঘটনা দেখতে পারলে তবেই বুঝব যে, তুমি আল্লাহর সত্য নবী। এমন মুহূর্তে ফেরেশতা জিবরাইল আ: এসে তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি তাদের কাছ থেকে একটি ওয়াদা আদায় করুন যে, তারা যেন ঈমান আনে।
তারপর হজরত সালেহ আ: তাদেরকে এই ওয়াদা করালেন। হজরত সালেহ আ: আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। সাথে সাথে একটি সুন্দর উটনী ওই পাহাড়ের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। এ রকম সুন্দর উটনী কেউ কোনো দিন দেখেনি। উটনী বের হওয়া মাত্র একটি অতি সুন্দর বাচ্চা প্রসব করল এবং সাথে সাথে নিকটবর্তী চারণভূমিতে ঘাস খেতে শুরু করল। হজরত সালেহ আ:-এর এই মোজেজা দেখার পরও কেউ ঈমান আনেনি, সামুদ জাতি ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘আর হে আমার কওম! এটি হচ্ছে আল্লাহর উষ্ট্রী যা তোমাদের জন্য নিদর্শন। অতএব ওকে ছেড়ে দাও যেন আল্লাহর জমিনে চরে খায়, আর ওকে খারাপ উদ্দেশে স্পর্শ করো না, অন্যথায় তোমাদেরকে আকস্মিক শাস্তি এসে পাকড়াও করতে পারে।’ (সূরা হুদ, আয়াত-৬৪)
আল্লাহর কী অপার মহিমা! ঘটনাক্রমে ওই মাসে ১০ জন মহিলা ১০টি পুত্রসন্তান প্রসব করল। তারা সবাই হজরত সালেহ আ:-এর উক্তি শুনেছিল, সুতরাং ৯ জন মহিলাই নিজ নিজ সন্তান মেরে ফেলল; কিন্তু একজন মহিলা তার সন্তান মেরে ফেলল না; বরং তাকে সে আদর-যত্নে লালন পালন করতে লাগল। ছেলেটি অত্যন্ত হৃষ্টপুষ্ট ও শক্তিশালী হলো। ওই ছেলেটির নাম রাখা হয়েছিল কেদার। তাদের অত্যন্ত ক্ষোভ এবং বিরক্ত জন্মে গেল হজরত সালেহ আ:-এর ওপর। তারা বলতে লাগল, আমরা খালি খালি হজরত সালেহ আ:-এর কথায় বিশ্বাস করে নিজরা সন্তানহারা হলাম। ওই মহিলাদের ক্ষোভ এবার প্রতিহিংসার রূপ পরিগ্রহ করল। তাদের কথাবার্তা শুনে অনেকেরই আস্থা ও বিশ্বাস হজরত সালেহ আ:-এর ওপর থেকে কমে গেল। তারা মনে করতে লাগল যে, একটি উটনীকে কেন্দ্র করে অনাহূত নিষ্পাপ ৯টি শিশু-সন্তান অকালে প্রাণ হারাল, সুতরাং তাদের অনেকেই এরূপভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো যে, ওই উটনীকে তারা হত্যা করে ফেলবে; কিন্তু এ কথা কেউই চিন্তা করল না যে, হজরত সালেহ আ: সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ওই উটনীর প্রতি কেউ কোনোরকম অসদাচরণ করলে আল্লাহর তরফ থেকে কঠোর আজাব আসবে।
সামুদ জাতির দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এসেছিল। তাই শিগগিরই একদিন উল্লিখিত কেদার ও মেছদা একসাথ হয়ে নেশার বস্তু পান করে এরূপ যুক্তি করল যে, উটনীটিকে হত্যা করার দায়িত্ব তারা পালন করবে। কওমের কতিপয় শরাবপায়ী তাদের এ ব্যাপারে আরো উৎসাহ দিলো। উটনী যখন কূপের তীরে পানি পান করতে আসবে, তখনই তারা কাজ সাধন করবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। পরবর্তী দিন উটনীটে যখন ওই কূপের তীরে পানি পান করতে উপস্থিত হলো, অস্ত্রের আঘাতে উটনীটিকে হত্যা করে ফেলল।
উটনী হত্যা সম্পর্কিত ঘটনা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘অনন্তর তারা ওকে মেরে ফেলল, তখন সে বলল- তোমরা নিজেদের ঘরে আরো তিন দিন বাস করে নাও; এটি ওয়াদা, যাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই।’ (সূরা হুদ-৬৫) হজরত সালেহ আ: যখন উটনীর মৃত্যুসংবাদ শুনতে পেলেন, তিনি নিজের কওমের লোকদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, তোমরা এখন আর মাত্র তিনটি দিন দুনায়াবি আরাম-আয়েশ করে নিতে পার। তিন দিনের প্রথম দিন তোমাদের সবার চেহারা সবুজ রঙ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় দিন তা লাল রঙ ধারণ করবে। আর তৃতীয় দিন তোমাদের মুখম-ল ও সারা দেহ ঘোর কালো রঙ হয়ে যাবে। তার পরবর্তী দিনে তোমাদের প্রতি নেমে আসবে আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে গজব। হজরত সালেহ আ: বর্ণিত এ ধ্বংসের নিদর্শন যখন প্রকাশ পেল তখন যারা ওই হত্যায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, তারা হজরত সালেহ আ:-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাঁর ঘরে যাত্রা করল; কিন্তু ইতোমধ্যেই তাদের ওপর আল্লাহর গজব পৌঁছে গেল। তখন আর নবীকে হত্যা করা তো দূরের কথা, নিজেদের বাঁচার চিন্তায়ই অস্থির হয়ে পড়ল। তারা আবার দৌড়ে গিয়ে যার যার ঘরে আশ্রয় নিলো; কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাইল তখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছেন। তিনি সামুদ জাতির লোকদের ঘরগুলোকে ধরে সামান্য নাড়া দিলেন, আর তাতেই সেগুলো সব ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেল। অতঃপর হজরত জিবরাইল আ: এমন এক প্রচ- হুঙ্কার দিলেন, যার হৃদয় ফাটানো আওয়াজে সব লোক অজ্ঞান হয়ে পড়ল এবং সাথে সাথে তারা মাটির মধ্যে পড়ে গিয়ে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাদের আর কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট রইল না।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘তারা এক চক্রান্ত করেছিল এবং আমিও এক কৌশল অবলম্বন করলাম; কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি। অতএব দেখো, তাদের চক্রান্তের পরিণাম কী হয়েছে। আমি অবশ্যই তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়ের সবাইকে ধ্বংস করেছি। এই তো তাদের ঘরবাড়ি সীমালঙ্ঘন হেতু যা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে; এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে এবং যারা মু’মিন ও মুত্তাকি ছিল তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছি।’ (সূরা আন নমল, আয়াত- ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩)। লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক