লন্ডনভিত্তিক অর্থনৈতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর ১৯৯৪ সালের ৬ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সার্ভে অব ইসলাম’ শীর্ষক দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : অতীতে বিশ্ববাসী মুসলিম স্পেন ও আন্দালুসিয়া থেকে আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ে জেনেছিল এবং ইসলামের কাছ থেকে ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল। আর এখনকার বিশ্ব ইসলামের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আইডিয়া গ্রহণ করতে পারে। পত্রিকাটির দৃষ্টিতে মুসলমানদের অতীত গৌরব তার শিক্ষা-সংস্কৃতি। আর দীর্ঘকাল পর মানবজাতির প্রতি ইসলামের বর্তমান উপহার ‘ইসলামী ব্যাংকিং’।
যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ডব্লিউ উইলসন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মুসলিম দেশগুলোর পুরো অর্থব্যবস্থা, বিশেষ করে ব্যাংকব্যবস্থা, সুদমুক্ত করা না গেলে তারা পুরো জনগণকে কোনো দিনই অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত করতে পারবে না। তাতে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতি কখনো অপটিমাম লেভেলে পৌঁছাবে না। তার এ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ইউরোপ-আমেরিকা যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে তার জন্য কি সুদ নিষিদ্ধ করতে হয়েছে? উত্তরে ড. উইলসন বলেছেন, ইউরোপ-আমেরিকার জনগণ সুদকে সেভাবে ঘৃণা করে না যেভাবে মুসলমানরা করে। সে কারণে সুদে যত লাভই থাকুক সব মুসলমান সুদের কারবারে জড়াবে না। যেমন- তুলনামূলকভাবে ঢের সস্তা হওয়া সত্ত্বেও একজন মুসলমান গরুর গোশতের বদলে কোনো দিন শূকরের মাংস কিনবে না।
২০০৯ সালে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু ভেটিকানের পোপ তার এক বাণীতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে সম্পদভিত্তিক ব্যাংকিং করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তোমাদের ব্যাংকিং হলো ‘ঋণভিত্তিক’। অন্য দিকে ইসলামী ব্যাংকিং হলো ‘সম্পদভিত্তিক’। তোমাদের ব্যাংকিং হলো ‘লোভভিত্তিক’। অন্য দিকে, ইসলামী ব্যাংকিং হলো ‘প্রয়োজনভিত্তিক’। তোমাদের ব্যাংকিংয়ে মুনাফা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো আদর্শ নেই। অন্য দিকে ইসলামী ব্যাংকিং এক মহান আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামী ব্যাংকিংকে বলা হয় শরিয়াহ ব্যাংকিং। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল ভিত্তি হলো ইসলামী শরিয়াহ। শরিয়াহ নেই তো ইসলামী ব্যাংকিং নেই। এই নিয়ে কারো মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। অতএব এর কোনো ব্যাখ্যাও দরকার নেই। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সম্পদভিত্তিক লেনদেন বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বময় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কদর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই জনপ্রিয়তার কারণে এক দিকে যেমন নতুন নতুন ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, অন্য দিকে তেমনি প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তাদের বিদ্যমান খোলনলচে পাল্টে ইসলামী অবয়ব ধারণ করছে। আবার কেউ কেউ বিদ্যমান অবয়ব বহাল রেখেই পরিবেশন করছে ইসলামী ব্যাংকিং প্রডাক্ট। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংক হয়েও তার প্রচলিত ব্যাংকিং প্রডাক্টের পাশাপাশি বিক্রয় করছে ইসলামী ব্যাংকিং প্রডাক্ট। প্রশ্ন করতে পারেন, সেটি আবার কেমন ইসলামী ব্যাংকিং? বলছি সে কথা।
প্রচলিত ব্যাংক যখন ইসলামী প্রডাক্ট পরিবেশন করে
বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ব্যাংকগুলো তাদের প্রফিট মেক্সিমাইজ করার জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে থাকে তার একটি হলো হালাল প্রডাক্ট পরিবেশন। প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে যেসব হালাল প্রডাক্ট পরিবেশন করতে দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো মুশারাকা, মুরাবাহা ও ইজারা ইনস্ট্রুমেন্ট। মুসলিম দেশগুলোয় যেসব বিদেশী ব্যাংক ব্যবসা করে তারা মুসলিম গ্রাহকদের আকর্ষণ করার জন্য এসব ইনস্ট্রুমেন্ট অফার করে থাকে। এসব প্রডাক্ট যে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ম্যানেজ করা হয় তা নয়; বরং এগুলো তাদের প্রচলিত ব্যাংকিং সেবারই অংশ। এ কারণে এসব প্রডাক্ট সম্পর্কে জনসাধারণের সন্দেহ অনেক। এ কারণে এসব প্রডাক্ট ব্যবহার করার আগে অধিকতর সতর্কতার সাথে শরিয়াহ স্কলারদের মতামত জেনে নেয়া উচিত। অবশ্য ফকিহরা এ ব্যাপারে নানা মত পোষণ করেন। যেমন- একদল ফকিহ মনে করে, মুসলমানদের এসব সেবা এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ এখানে শরিয়ত পরিপালনের ঘাটতি রয়েছে।
ফকিহদের আরেকটি দল মনে করে, যদি বিষেশায়িত ইসলামী ব্যাংক না পাওয়া যায় তখন মন্দের ভালো হিসেবে এসব সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মুনাফাটা পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে। আর দেখতে হবে লেনদেনের কত ভাগ হালাল আর কত ভাগ হারাম।
প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত
প্রচলিত ব্যাংক কর্তৃক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো বা ইউনিট পরিচালনাকে ঘিরে শরিয়াহ স্কলার ও ইসলামী ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছুটা মতভিন্নতা রয়েছে। একদল এ ব্যবস্থার পক্ষে। অন্যদল বিপক্ষে।
পক্ষ মত : ফকিহদের একদল মনে করে, প্রচলিত ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিট খোলা যেতে পারে, যদি উদ্যোক্তারা তাদের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিটগুলোর সব কাজে পূর্ণ ইসলামী শরিয়তের বিধান মেনে চলায় অঙ্গীকারবদ্ধ হন। এ মতের পক্ষে তাদের যুক্তি হলো- প্রথমত, ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিটগুলো অন্তত সুদটা পরিহার করে, যা আর্থিক লেনদেনে ইসলামী শরিয়তের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।
দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু দেশে পূর্ণ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। সে ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিট খোলা হলো তার একমাত্র বিকল্প। তাতে এই ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিটগুলো যদি ব্যবসায় সফল হয়- প্রচলিত শাখাগুলোর তুলনায় বেশি মুনাফা দিতে পারে তাহলে শেয়ারহোল্ডাররা পুরো ব্যাংকটিই রূপান্তরে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিট চালু করাটা হতে পারে ওই ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি প্রয়োগের প্রথম পদক্ষেপ।
তৃতীয়ত, ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিটগুলো তাদের প্রচলিত মাতৃশাখার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হতে পারবে। এটি ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
বিপক্ষ মত : ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিট কনসেপ্টের বিরোধীরা মনে করেন, এটি হলো মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার এক নতুন পন্থা। এখানে আল্লাহর বিধানের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা ও আনুগত্য নেই, আছে ইসলামের নামে ইসলামী তহবিল হস্তগত করার অপকৌশল। ইসলামী সাবসিডিয়ারি কোম্পানি তথা ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিটের সাথে লেনদেন করা অবৈধ হওয়ার পক্ষে দলিল হিসেবে তারা কুরআন মাজিদের আয়াতগুলো পেশ করেন-
‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি সত্যি সত্যি মু’মিন হও। যদি সুদ না ছাড়ো তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। তবে যদি তোমরা তাওবাহ করো তাহলে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে।
প্রচলিত ব্যাংকের মূলধন দিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো/ইউনিট প্রতিষ্ঠার বৈধতা নিয়েও কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে হারাম ও হালালের মিশ্রণ ঘটবে।
চূড়ান্ত মত : উম্মাহর মেজরিটি অংশ মনে করেন, একটি পুরোপুরি সুদভিত্তিক ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার চেয়ে প্রচলিত ব্যাংকের একটি ইসলামী শাখা বা ইসলামী উইন্ডো/ইউনিটের সাথে লেনেদেন করা অনেক ভালো। তাদের মতের পক্ষে তারা ইমাম হাফেজ ইবনুল কাইয়ুম আল-জাওজির একটি রায় পেশ করেন, যাতে তিনি বলেছেন- যখন হালাল টাকার সাথে হারাম টাকা মিশে যায় তখন আমাদের উচিত অপবিত্র টাকাকে পবিত্র করে নেয়া। অর্থাৎ মোট টাকার মধ্যে যে পরিমাণ হারাম টাকা রয়েছে তা আলাদা করে চ্যারিটিতে ব্যয় করতে হবে। আর হালাল অংশ রেখে দিতে হবে।
লেখক : সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং