প্যারিসে ১৭ বছরের তরুণ নাহেলের মৃত্যুর জেরে গত পাঁচদিন ধরেই বিক্ষোভ সহিংসতায় উত্তাল ফ্রান্স। শনিবার রাতে সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত ছিল ফ্রান্সের মার্সেই শহর। সেখানে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে বিক্ষোভকারীদের দমন করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করছে। কর্মকর্তারা বলছেন ফ্রান্সে দক্ষিণা লীয় এই শহরে শনিবার রাতেই অন্তত ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে প্যারিসের পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত ছিল শনিবার রাতে। সেখানে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিক্ষোভকারীরা সংগঠিত হতে পারেনি। অব্যাহত বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্যেই শনিবার নাহেলের দাফন সম্পন্ন হয়। নানতেরে শত শত মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়েছিল।
আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ১৭ বছর বয়সী তরুণ নাহেল মেরজুকের মৃত্যুর পর গত মঙ্গলবার থেকেই ফ্রান্সজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন শনিবার রাতেই অন্তত ৪২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন এই বলে যে “তাদের পদক্ষেপের জন্যই শনিবার রাতের পরিস্থিতি শান্ত ছিল”।
অব্যাহত দাঙ্গা ঠেকাতে শনিবারেই ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৪৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবার জানিয়েছিল যে চার দিনে অন্তত ২৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে শুক্রবার রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় ১৩১১ জনকে। ফ্রান্সের বিচার মন্ত্রী বলেছেন গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম। শনিবার বিকেল থেকেই মার্সেই শহরের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে মার্সেইয়ের কেন্দ্রস্থল লা ক্যানেবিয়েরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ফরাসি মিডিয়াগুলোর খবর অনুযায়ী ওই এলাকায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে লড়াই চলে।
তবে প্যারিসে পুলিশি টহল ছিল অনেক। রাজধানীর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী – কিছু বিক্ষোভকারী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হবার চেষ্টা চালায়, কিন্তু তারা আর সংগঠিত হতে পারেনি। স্থানীয় সময় রাত নয়টার পর থেকে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়। সহিংসতার আশঙ্কায় শনিবার রাতে অন্তত ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অব্যাহত দাঙ্গা ঠেকাতে শনিবারেই ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৪৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়।
যেভাবে সহিংসতার শুরু:ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নানতেরে এলাকায় নাহেল এম নামের ওই তরুণ মঙ্গলবার গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় ট্রাফিক পুলিশ তাকে থামতে বলে। সে না থামলে পুলিশ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ অফিসার একটি গাড়ির চালকের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এর পর একটি গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তারপর গাড়িটি থেমে যায়। বুকে গুলিবিদ্ধ নাহেলকে জরুরি চিকিৎসা দেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। গুলিবর্ষণকারী অফিসারটিকে হত্যার অভিযোগে আটকও করা হয়। ফরাসী মিডিয়ায় বলা হয়, পুলিশ প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তরুণটি তাদের দিকেই গাড়িটি চালিয়ে দিয়ে পুলিশদের আহত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে ধারণা করা হয় যে প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন। এ ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হয়।
গাড়ি ও বাসস্টপে আগুন দেয়া হয়, কিছু রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়, আক্রান্ত হয় পুলিশ স্টেশনও। রায়ট পুলিশ বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। যে পুলিশ অফিসারের গুলিতে নাহেল মারা যান, তিনি তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছেকৃতভাবে খুনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে পুরো ফ্রান্স সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে।
কে এই নাহেল এম? প্যারিসের নানতেরে শহরেই বেড়ে ওঠেন ১৭ বছর বয়সী নাহেল এম। তিনি খাবার ডেলিভারির কাজ করতেন এবং রাগবি লিগে খেলতেন। একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন তার মা।
নাহেলের পড়ালেখা কিছুটা অগোছালো হিসেবে বর্ণনা করা যায়। ইলেকট্রিশিয়ান হতে চেয়েছিল নাহেল। আর সেজন্যে যে এলাকায় তার বসবাস ছিল, তার কাছেই সুরেসনেসের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে।
যারা নাহেলকে চেনেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নাহেল ভালো ছেলে ছিল এবং সবাই তাকে ভালোবাসতো।
নাহেল ও তার মা মোনিয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত, তবে তার বাবা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। কলেজে নাহেলের ক্লাসে ছিল উপস্থিতি কম। সে হয়তো এর আগেও কোন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের কাছেও সে পরিচিত ছিলো। তবে নাহেলের পরিবারের আইনজীবী জোর দিয়ে বলছে, তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই।