(শেষাংশ)
প্রবৃত্তি পূজারিদের শাস্তি : যুগে যুগে শুধু অমুসলিম নয় মুসলিমদের দিকে তাকালেও দেখা যায় শুধু প্রবৃত্তির গোলামির কারণে লাখো-কোটি মুসলিম ইসলামের পথ পরিহার করে নানাবিধ অনৈসলামিক কর্মকা-ে লিপ্ত থেকে জাহান্নামে তাদের বাসস্থান তৈরি করে নিয়েছে।
হাদিসে আছে, আল্লাহ তায়ালা যখন জান্নাত সৃষ্টি করলেন তখন জিবরাইল আ:-কে বলেন, ‘যাও দেখে আসো, অতঃপর তিনি গিয়ে তার দিকে এবং তার মধ্যে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতবাসীদের জন্য যে নিয়ামতরাজি প্রস্তুত করে রেখেছেন তা দেখলেন। তারপর ফিরে এসে বলেন, হে রব! আপনার ইজ্জতের শপথ! জান্নাতের কথা কেউ শুনে তাতে প্রবেশ না করে থাকবে না। তারপর তিনি তাকে কষ্ট-ক্লেশ দ্বারা ভরপুর করে দিলেন। তারপর বলেন, ‘হে জিবরাইল! যাও তা দেখে আসো। অতঃপর তিনি গেলেন এবং দেখে এসে বলেন, হে রব আপনার ইজ্জতের শপথ! নিশ্চয়ই আমি ভয় করছি যে, তাতে কেউ প্রবেশ করবে না।’
রাসূল সা: বলেন, ‘অতঃপর যখন আল্লাহ পাক জাহান্নাম সৃষ্টি করলেন, তখন বলেন- ‘হে জিবরাইল! তুমি যাও, তা দেখে আসো। অতঃপর তিনি গেলেন এবং দেখে এসে বললেন, হে প্রভু! আপনার ইজ্জতের শপথ! জাহান্নামের কথা যে শুনবে সে তাতে প্রবেশ করবে না। তারপর তিনি তাতে কুপ্রবৃত্তির বাসনা দ্বারা ভরপুর করে দিলেন এবং বলেন- ‘হে জিবরাইল! তুমি যাও এবং তা দেখে আসো। অতঃপর তিনি গেলেন এবং দেখে এসে বলেন, হে প্রভু! আপনার ইজ্জতের শপথ! নিশ্চয়ই আমি ভয় করছি যে, কেউ তাতে প্রবেশ না করে থাকবে না।’ (আবু দাউদ)
ওই হাদিসে দু’টি বিষয় বেশি পরিষ্কার- ১. জান্নাতে প্রবেশ করতে গেলে মানুষকে নিদারুণ কষ্ট-ক্লেশ ভোগ করতে হবে। ২. আর জাহান্নামে মানুষ প্রবেশ করবে তার প্রবৃত্তির বাসনায় বা তাড়নার বশবর্তী হয়ে। দুনিয়ার দিকে তাকালে এ দুটো কথার বাস্তবতা সর্বক্ষণ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমরা এখানে ২ নম্বর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। দেখি একজন কিডনি রোগী, যার প্রায় দু’টি কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে, শত চিকিৎসায়ও তা ভালো হচ্ছে না। কিংবা হার্ট, লাে র কঠিন রোগী বা লিভার সিরোসিস হয়েছে বা কঠিন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত অর্থাৎ- এমন রোগী যাদের মৃত্যু যেন শিয়রে বসে আছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমতাবস্থায়ও অনেকে প্রবৃত্তির তাড়নায় বৈধ-অবৈধ জিনিসের তোয়াক্কা না করে দু-হাতে অর্থ কামায়। নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, ক্ষমতার লোভ তাকে তা অর্জনের জন্য হারাম পথে তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক বয়সে ন্যুব্জ বা বয়োবৃদ্ধ লোকও প্রবৃত্তির তাড়নায় বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণে, শিল্পকল-কারখানা বিনির্মাণে বা বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে যে সালাত পড়ার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না। অথচ সে অনেকটা নিশ্চিত যে, সে দ্বীর্ঘ দিন এটি ভোগ করতে পারবে না। জাকাতকে জরিমানা মনে করে। অনেকের ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকার পরও প্রবৃত্তির তাড়নায় অপরের স্ত্রীর সাথে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা পরকীয়ার বিনোদন উপভোগ করে। অনেক স্ত্রীও ঘরে স্বামী রেখে অপর নারীর ভালোবাসায় ভাগ বসিয়ে তার ঘর ভেঙে দেয়। অনেকে নামের আগে আলহাজ খেতাব লাগায়। তাহলে তার এ হজ কি খেতাব লাভের জন্য? আবার অনেকে প্রবৃত্তির মোহে অর্থ থাকার পরও হজ করে না এই ভেবে যে, অর্থ কমে যাবে। এমন ভূরি ভূরি পাপ-মহাপাপ করে থাকে মানুষ প্রবৃত্তির তাড়নায়। অনেক রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, দরিদ্র শ্রমিক কপালের ঘাম পায়ে ফেলে শ্রম দেয়ার পরও সালাত-সিয়াম ত্যাগ করে না। অথচ অনেকে সুখের বিছানায় থেকেও সালাত-সিয়াম ঠিকমতো আদায় করতে পারে না। এভাবে হেন অপরাধ নেই যা অনেকে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনায় বশীভূত হয়ে করে না।
এ জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘সেই সফলকাম যে নিজেকে (নফসকে) শুদ্ধ করেছে।’ (সূরা শামস-৯) সূরা আলাতেও অনুরূপ বলা হয়েছে।
মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘যে তার রবের সম্মুখে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং নিজের নফসকে কামনা বাসনা থেকে বিরত রাখে, অবশ্যই জান্নাত হবে তার ঠিকানা।’ (সূরা নাজিয়াত : ৪০-৪১)
যারা প্রবৃত্তির দাসত্ব করে সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, জিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত থাকবে, চুরি, ডাকাতি রাহাজানি করবে, পরের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে নির্যাতন করবে, মানুষ হত্যার মতো জঘন্য পাপ করবে, পর্দাকে উপেক্ষা করে উলঙ্গপনাকে বেছে নেবে; এভাবে পাপ-পঙ্কিলতার তোয়াক্কা না করে জীবন পরিচালনা করবে- কিয়ামতের ময়দানে নেকি-বদির পাল্লায় (মিজানে) তাদের আমলনামা হালকা হবে।
মহান আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন- ‘আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া (ভয়ঙ্কর দোজখ)। (ও নবী) আপনি জানেন তা কি? (তা হলো) প্রজ্ব¡লিত অগ্নি।’ (সূরা কারিয়া : ৮-১১)
এখান থেকে বোঝা যায়- প্রবৃত্তির দাসত্ব করলে তাকে জাহান্নামের অতল গহ্বরে জ্বলতে হবে। আর জান্নাতে যেতে হলে তাকে প্রবৃত্তির দাসত্ব মুক্ত হতে হবে। নবী করিম সা: বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবান ছাড়া কেউ দোজখে যাবে না’। বলা হলো- হে আল্লাহর রাসূল, সে দুর্ভাগ্যবান ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার জন্য কোনো নেক আমল করবে না এবং কোনো গুনাহের কাজ সে না করে ছাড়বে না।’ (ইবনে মাজাহ) মহান আল্লাহ এদের শাস্তি সম্পর্কে বলেন- ‘নিশ্চয়ই পাপী লোকেরা অনন্তকাল দোজখের কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।’ (সূরা আজ জুখরুফ-৭৪)
মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘অতঃপর সেখানে সে মরবেও না, জীবিতও থাকবে না।’ (সূরা আলা-১৩) একটু ভাবুন তো, যে ব্যক্তি বিছানায় অসুস্থাবস্থায় কাতরায় তারও সুস্থতার একটি আশা থাকে অথবা সে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে। অথচ জাহান্নামের শাস্তিতে এ দু’টি অবস্থা উপেক্ষিত। তাহলে সর্বক্ষণ মানুষ এ মর্মন্তুদ শাস্তিতে কিভাবে দিনাতিপাত করবে? কিংবা তার জন্য এ শাস্তি কেমন অসহ্যকর! একটু চিন্তা করি তো!
মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘যখন তাদের চামড়াগুলো জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আমি তা পাল্টে অন্য (নতুন) চামড়া দেবো, যাতে তারা (আমার) আজাবের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে।’ (সূরা নিসা-৫৬)
জাহান্নামের অন্যান্য শাস্তি
জাক্কুম ফল ভক্ষণ : মহান আল্লাহ বলেন- ‘তারা (জাহান্নামিরা) অবশ্যই ভক্ষণ করবে জাক্কুম বৃক্ষ থেকে। অতঃপর তা দিয়ে উদর পূর্ণ করবে। অতঃপর তার ওপর তারা পান করবে উত্তপ্ত পানি। পান করবে পিপাসিত উটের মতো। এটিই তাদের আপ্যায়ন।’ (সূরা ওয়াকিয়াহ : ৫২-৫৫) সাধারণত খাবারের সময় পানি পানের প্রয়োজন হয়।
সূরা আস সাফ্ফাতে বলা হয়েছে- ‘এটি একটি বৃক্ষ, যা উদগত হয় জাহান্নামের মূলে। এর গুচ্ছ শয়তানের মস্তকের মতো।’ (আয়াত : ৬৪-৬৫)
মহানবী সা: বলেন, ‘যদি জাক্কুমের একটি ফোঁটা দুনিয়ায় পড়ত তবে দুনিয়াবাসীদের খাদ্য-পানীয় সব নষ্ট হয়ে যেত। তাহলে কেমন হবে যাদের খাদ্যই হবে শুধু জাক্কুম।’ (তিরমিজি)
মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘কণ্টকপূর্ণ ঝাড় ব্যতীত তাদের জন্য কোনো খাদ্য নেই। এটি তাদের পুষ্ট করবে না এবং ক্ষুধায়ও উপকার করবে না।’ (সূরা গাশিয়াহ : ৬-৭)
ফুটন্ত পানি, পুঁজ, রক্ত হবে পানীয় : মহান আল্লাহ বলেন- ‘তাদেরকে ফুটন্ত নহর থেকে পান করানো হবে।’ (সূরা গাশিয়াহ-৫) তিনি আরো বলেন, ‘তাদেরকে (জাহান্নামিদেরকে) পান করানো হবে ফুটন্ত পানি। অতঃপর তা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নবিছিন্ন করে দেবে।’ (সূরা মুহাম্মাদ-১৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘তাকে (জাহান্নামিকে) পুঁজযুক্ত পানি পান করানো হবে। ঢোঁক গিলে তা পান করবে এবং গলার ভেতরে প্রবেশ করাতে পারবে না।’ (সূরা ইবরাহিম-১৬) তিনি আরো বলেন- ‘কোনো খাদ্য নেই ক্ষত নিঃসৃত পুঁজ ছাড়া, যা গুনাহগার ব্যতীত আর কেউ খাবে না।’ (সূরা হাক্কাহ : ৩৬-৩৭)
সামুরা ইবনে জুনদুব রা: থেকে বর্ণিত- দীর্ঘ হাদিস, যাতে রাসূল সা: তাঁর স্বপ্নের কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, তিনি দেখলেন- সুদখোর ব্যক্তি ঝরনার মধ্যে সাঁতার কাটছে। রাবি বলেন, মনে হয় তিনি বলেছেন, যার পানির রঙ ছিল রক্তের মতো লাল। (অর্থাৎ কুরক্ত)।’ (বুখারি)
বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছুর দংশন : মহানবী সা: বলেন, ‘যাকে আল্লাহ ধনসম্পদ দান করেছেন আর সে তার জাকাত আদায় করেনি কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকোমাথা সাপরূপে বানানো হবে, যার চেখের উপরে দু’টি কালো বিন্দু থাকবে। কিয়ামতের দিন তাকে তার গলায় বেড়ি করে দেয়া হবে। অতঃপর সে সাপ তার মুখের দুই দিকে কামড় দিয়ে ধরবে তারপর বলবে আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সংরক্ষিত ধন।’ (বুখারি)
পরনিন্দাকারীর শাস্তি : পশ্চাতে-সম্মুখে পরনিন্দাকারীর শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘কখনো না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামাতে (এমন অগ্নি যা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে)। আপনি কি জানেন সে হুতামা কি? এটি আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা হৃৎপি- পর্যন্ত পৌঁছবে। নিশ্চয়ই তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। (বাঁধা হবে) লম্বা লম্বা (আগুনের) খুঁটিতে।’ (সূরা হুমাজাহ : ৪-৯)
এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়- আগুন হৃৎপি- পর্যন্ত পৌঁছবে কিন্তু মৃত্যু হবে না। দুনিয়াতে এমন হওয়ার আগেই মানুষের মৃত্যু হয়ে যায়। দেয়াল হবে আগুনের। লাফ-ঝাঁপ যাতে দিতে না পারে তার জন্য লম্বা লম্বা আগুনের স্তম্ভে বেঁধে রাখা হবে। এখানে আজাবের যে ধরন বলা হয়েছে তাতে এই একটি আয়াত নিয়ে চিন্তা করলেই তা নিজের জীবনে পরিচ্ছন্নতা আনয়নে যথেষ্ট।
অত্যুষ্ণ বায়ু : মহান আল্লাহ বলেন- ‘জাহান্নামিরা থাকবে অত্যুষ্ণ বায়ু, উত্তপ্ত পানি এবং ধূম্রকুঞ্জের ছায়ায়, যা সুশীতল ও আরামদায়ক নয়।’ (সূরা ওয়াকিয়াহ : ৪২-৪৪) এটিও একটি তাদের জন্য কঠিন আজাব।
পরিশেষে সবাইকে মহান আল্লাহ পাকের ওই বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব- ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সূরা আল ইমরান-১০২) সুতরাং পরকালে জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচতে হলে মহান আল্লাহ পাকের দ্বীনকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে এবং জীবন চলার পথে সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করতে হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক