পৃথিবীর ইতিহাসে যত প্রলয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় দিন অতীতে এসেছে, বর্তমানে আসছে ও ভবিষ্যতে আসবে তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় দিন হলো কিয়ামতের দিন। সে দিন আকাশ বিদীর্ণ হবে। সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে। নক্ষত্রসমূহ খসে খসে পড়বে। পর্বতমালাকে চালিত করা হবে। সাগরগুলোকে এক সমুদ্রে পরিণত করে উত্তাল করে তোলা হবে। হাশরের ময়দান প্রতিষ্ঠিত হবে। সূর্যকে তেজোদীপ্ত করে মানুষের একদম কাছাকাছি আনা হবে। সে দিন মানুষ নিজেদের ঘামে হাবুডুবু খাবে। এ দিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ সাত শ্রেণীর লোককে আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
ন্যায়পরায়ণ শাসক : বিভিন্ন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাসীন হয়। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বহু শাসক প্রজাসাধারণের সাথে অন্যায় আচরণ করতে থাকে। খুন, গুম ও অবিচারের মাধ্যমে নাগরিকদের ওপর সীমাহীন জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। পক্ষান্তরে কিছু ন্যায়পরায়ণ শাসক এমন হয়ে থাকেন যারা সামাজিক সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তারা প্রজাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করেন। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের নাগরিকদের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় শতভাগ প্রয়াস চালান। প্রজাদের ওপর জুলুম নির্যাতন করা হতে বিরত থাকেন। ন্যায়পরায়ণ শাসকদের আল্লাহ তায়ালা তার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
ইবাদতগোজার যুবক : যৌবন আল্লাহ প্রদত্ত এক অনন্য নিয়ামত। যৌবনে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। যৌবনকালে অন্যায়, অনাচার ও পাপাচার করার শক্তি থাকে। একজন যুবক ইচ্ছা করলে তার যৌবনকালকে অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, অজাচার, ব্যভিচার, জিনা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনায় কাটিয়ে দিতে পারে। আবার সে ইচ্ছা করলে তার যৌবনকাল আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগিতেও অতিবাহিত করতে পারে। যৌবনকালের ইবাদত আল্লাহ তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয়। কেননা এ সময় সে ইবাদত না করে অপরাধ জগতেও ডুবে থাকতে পারে। অতএব, যেসব যুবক নিজেদের যৌবনকালকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করবে এবং অন্যায়, অনাচার ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকবে তাদেরকে মহান আল্লাহ আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
মসজিদমুখী ব্যক্তি : মুসলমানদের ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। কিছু মানুষ এমন রয়েছেন যারা নিয়মিতভাবে মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার পর অন্য ওয়াক্তের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন। ভাবতে থাকেন, কখন আজান হবে আর মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করব। নামাজের ব্যাপারে এসব লোকের মনোযোগের প্রতি দৃষ্টিপাত করে মনে হয়, তাদের অন্তর মসজিদের সঙ্গে ঝুলন্ত রয়েছে। যেসব লোক নামাজ আদায় করার ব্যাপারে এমন যতœবান থাকেন এবং মসজিদে যাওয়ার লক্ষ্যে আজান হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকেন এমন মসজিদমুখী লোকদেরকে মহান আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
আল্লাহর জন্য মহব্বতকারী : মানুষ সামাজিক জীব। সে একাকী বাস করতে পারে না। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে একে অপরের সাথে ওঠা-বসা করতে হয়। এই ওঠা-বসা কখনো হতে পারে পার্থিব স্বার্থকে সামনে রেখে। ব্যক্তি প্রয়োজনকে পূরণ করার জন্য এবং দুঃসময়ে সাহায্য পাওয়ার জন্যও ওঠা-বসা হতে পারে। সমাজের অধিকাংশ লোকের ওঠা-বসা পার্থিব স্বার্থকে সামনে রেখেই হয়ে থাকে। আবার আল্লাহর কিছু বান্দা এমনও রয়েছেন যারা একে অপরকে কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যই মহব্বত করেন এবং মহান আল্লাহর জন্যই ভালোবাসেন। যদি কাউকে দেখেন, তিনি আল্লাহর কাজ করেন, সৎকর্ম সম্পাদন করেন, তাহলে আল্লাহ তায়ালার জন্য তাকে ভালোবাসেন। আবার যদি কখনো কাউকে দেখেন সে আল্লাহর নাফরমানি করে, আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টিমূলক কাজ করে, তাহলে তাকে ঘৃণা করে তার কাছ থেকে পৃথক হয়ে যান। যেসব লোক মানুষকে আল্লাহ তায়ালার জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্যই পৃথক হয় তাদেরকে মহান আল্লাহ নিজের আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
জিনার আহ্বান প্রত্যাখ্যানকারী : যৌবনকালে অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলাল্লাপনার বহু সুযোগ এসে থাকে। যদি কোনো যুবক চায়, তাহলে সে এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের যৌন চাহিদা পূরণ করতে পারে। নিজের উদগ্র কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে পারে। জৈবিক চাহিদা পূরণ করার বহু সুযোগ একজন যুবক পেয়ে থাকে। কিন্তু কোনো যুবক যদি আল্লাহর ভয়ে অবৈধ উপায়ে নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণ করা হতে বিরত থাকে, কোনো সম্ভ্রান্ত নারী যদি তাকে জিনা করার জন্য আহ্বান জানায় এবং সে আল্লাহ তায়ালার ভয়ে জিনা করা হতে নিবৃত্ত থাকে, নিজের উদগ্র কামনা বাসনা পূরণ করা হতে বিরত থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা জিনার আহ্বান প্রত্যাখ্যানকারী চরিত্রবান যুবককে কিয়ামতের কঠিন দিনে নিজের আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
গোপনে দানকারী : গোপনে ও প্রকাশ্যে উভয়ভাবে দান করা যায়। তবে দান করার ক্ষেত্রে নিয়ত থাকতে হবে আল্লাহ তায়ালার জন্য দান করা। মানুষ আমাকে দানবীর বা দানশীল বলুক এ জাতীয় চিন্তা অন্তরে লালন করা যাবে না। যদি কেবল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য দান করা হয়, তাহলে তা গোপনে হোক বা প্রকাশ্যে উভয়ভাবেই গ্রহণযোগ্য। অবশ্য আল্লাহর কিছু বান্দা এমন রয়েছেন যারা এমন ভাবে দান করেন, পৃথিবীর অন্য কেউ তার দান সম্পর্কে জানে না। এমন দান আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। যে দান এমন গোপনভাবে করা হয় যা সম্পর্কে কেউ জানে না তাকে এমন দান বলা হয় যার ব্যাপারে বাম হাতও জানে না। যেসব মানুষ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ছাড়া নিরেট আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে অকাতরে দান করেন মহান আল্লাহ এমন লোকদেরকে নিজের আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
নির্জনে জিকিররত ব্যক্তি : মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা নির্জনে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারা নীরবে-নিভৃতে মহান আল্লাহর সুমধুর নাম জপতে থাকেন। তার জিকির করতে থাকেন। একান্তে নিজের প্রেমময় প্রভুকে স্মরণ করতে থাকেন। আপন প্রেমাষ্পদকে স্মরণ করার সময়, মাওলার জিকির করার সময় তাদের চোখ দিয়ে আনন্দ ও বেদনার অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে। যেসব লোক নির্জনে ও নিভৃতে আল্লাহ তায়ালার জিকির করে এবং তাদের চোখ দিয়ে আনন্দ, বেদনা ও বিরহের অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে তাদেরকে মহান আল্লাহ আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন।
উল্লিখিত সাত প্রকার ব্যক্তি আরশের ছায়াতলে স্থান পাওয়ার ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে দিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন- ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক; ২. সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে; ৩. সে ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে; ৪. সে দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালোবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে, একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য; ৫. সে ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহ্বান জানায়, কিন্তু সে এ বলে প্রত্যাখ্যান করে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’; ৬. সে ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না; ৭. সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর জিকর করে, ফলে তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে’ (বুখারি, হাদিস-৬৬০)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উল্লিখিত সাত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া, ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা