হে আল্লাহর মেহমানগণ! আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিম মিল্লাতের নেতা, মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর ডাকে আল্লাহর ঘর তথা বাইতুল্লাহ, ওয়াদিল মুকাদ্দাস বা পবিত্র উপত্যকা মক্কা-মদিনায় বেশ কিছু দিন বেরিয়ে এলেন। আল্লাহর মেহমানদারির অনেক কিছুই সেখানে উপভোগ করেছেন। দীন-দুনিয়ার কল্যাণের অনেক নমুনা সেখানে দেখে এসেছেন। আরাফাতের বিশাল ময়দানে মানবতার নবী সা: তাঁর শেষ বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার এ কথাগুলো পরবর্তী বা পেছনে পড়ে থাকা লোকদের কাছে পৌঁছে দিও। হতে পারে তারা তোমাদের চেয়ে অধিকতর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিবে।’
হে আল্লাহর মেহমানগণ! এখন বলুন, আপনি আপনার পরিবার, আপনার সমাজ, আপনার দেশ ও জাতির জন্য কী পয়গাম বা বার্তা নিয়ে এলেন? যদি নিয়ে এসে থাকেন, তাহলে কোনো প্রকার দ্বিধা-সঙ্কোচ নয়, সব ধরনের জড়তা ছাড়াই আপনার পরিবার, সমাজ ও জাতির সামনে দাঁড়িয়ে যান এবং হজরত ইবরাহিম আ: এর মতো সগর্বে ঘোষণা দিন যে, হে আমার পরিবার! হে আমার সমাজ! হে আমার জাতি! তোমরা আজ যা করছ আমি সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র সেই প্রভুর দিকে ফিরে যাচ্ছি যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, যার সাথে কোনো শরিক নেই, আসমান জমিনে একমাত্র তাঁর রাজত্বই চলবে। আমি আরো ঘোষণা করছি, সৃষ্টি যার হুকুম চলবে তাঁর। কারণ হজে তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে আমি আল্লাহর কাছে সেই কথাই বলে এসেছি। আমি বলে এসেছি ‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকা ওয়াল মূলক, লা শারিকা লাক’। যার অর্থ : ‘আমি হাজির হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই এবং রাজত্ব তোমারই, তোমার কোনো শরিক নেই।’ অতএব, হে আমার জাতি! আল্লাহর মেহমানদারির সময়টাতে একবার নয় দু’বার নয় শতবার হাজারবার এ কথা বলে এসেছি। বলে এসেছি রাজত্ব ও হুকুমাত একমাত্র তোমারই চলবে। পুরো ৪০টি দিন সেই ওয়াদাই তো করে এলাম। আর প্রকৃত সত্য তো এটাই যে, তাঁর সৃষ্ট জমিনে অন্যের হুকুমাত তো কখনো চলতে পারে না। অর্থাৎ সৃষ্টি যার, আইনও চলবে তাঁর।
সুতরাং হে আমার পরিবার! হে আমার সমাজ! হে আমার জাতি! আমি নিমকহারামি করতে পারি না। যদি এমনটি করি তবে আমি একই সাথে ওয়াদাভঙ্গকারী মোনাফিক, মিথ্যাবাদী ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো। বাইতুল্লাহর চার দিকে আমার তাওয়াফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আমার সব কিছুই তথা আমার জীবনাচরণ এই ঘরকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হবে। আজ থেকে আমার জীবনে পরিবর্তনের একটা সূচনা সৃষ্টি হবে। আমার আরো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি দেশে গিয়ে আমার রাজনীতি, আমার সমাজনীতি ও আমার অর্থনীতি তথা আমার সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ ঘরের দিকে ফিরিয়ে আনার আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে যাবো। এ জন্য যদি আমার জান আমার মাল ও আমার পরিবার হুমকির সম্মুখীন হয় তাতে কোনো আপস ও পরোয়া কোনোটিই করব না। যেমনটি করেননি উহুদের ময়দানে শায়িত সাইয়েদুশ শুহাদা বীর আমির হামজাসহ ৭০ জন সাহাবি, যেমন সামান্যতম পিছপা হননি জান্নাতুল বাকিতে শায়িত লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম। যেমনটি জীবন-মরণ সঙ্কটেও সামান্যতম হতোদ্যম হননি গারে সওরে আশ্রয় নেয়া সারোয়ারে আলম ও তাঁর সাথী। মক্কার রাজা-বাদশা, ধনদৌলত ও সুন্দরী নারীর প্রলোভন যাঁর লোভকে উসকে দিতে পারেরি মক্কার কাফের সরদাররা। নিজ জাতির চরম বিরোধিতার মুখে মদিনায় হিজরত করে হলেও আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করে পৃথিবীবাসীর সামনে তার সুফল তিনি দেখিয়ে গেছেন। হজরত ইবরাহিম আ: তাঁর পরিবার, তাঁর জাতি ও রাষ্ট্রের শিরক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন, ‘ইন্নিওয়াজ জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরধা হানিফাও ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন।’ অর্থাৎ নিশ্চয় আমি আমার সেই প্রভুর দিকে ফিরে যাচ্ছি যিনি আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। সুতরাং হে আমার জাতি তোমরা যদি তোমাদের ভুল কর্মনীতি থেকে ফিরে না আসো তাহলে আমি তোমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে কা’বার মালিক মহান প্রভুর দিকে ফিরে যাচ্ছি, গত ৪০-৪৫ দিন কাবার চার পাশে তাওয়াফ করার সময় বারবার প্রভুর কাছে এই ওয়াদাই করে এসেছি।
আমি পবিত্র হজ থেকে সেই শিক্ষাই নিয়ে এসেছি। এখানে অন্যদের শাসন চলতে দেয়া মানে নিজেকে তাগুতের হাতে ছেড়ে দেয়া, তাগুতের সাথে আপস করা অথবা পুরোপুরি তাগুতের অনুসরণ করা, পক্ষান্তরে আল্লাহকে ছেড়ে দেয়া, আল্লাহর সাথে অন্যদের শরিক করা। যদি আল্লাহ ছাড়া অন্যদের শাসনব্যবস্থা মেনে নেই, তবে আমার নামাজ, আমার রোজা, আমার জাকাত ও হজ কী কাজে আসবে?
হে আমার জাতি! আমি আবারো ঘোষণা করছি, আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হুকুম, অন্য কারো পথ ও মত মানি না। আজ থেকে আমি সব পরিহার করে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবো। তোমরাও আমার সাথে শরিক হও। হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো, আমি তোমার মেহমানদারিতে যে পয়গাম নিয়ে এসেছিলাম তা আমি আমার জাতির কাছে পৌঁছে দিলাম। যাতে আমার জাতি আমাকে তোমার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারে। আমাকে তুমি কবুল করো। ( সূত্র: নয়াদিগন্ত অন লাইন)। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট