তওবা বলা হয় অতীতে কৃত পাপকর্মের ওপর পরিতাপদগ্ধ ও অনুশোচিত হওয়ার সাথে সাথে তা বর্জন করা এবং ভবিষ্যতে সেই পাপে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ়সঙ্কল্পে আবদ্ধ হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহর কাছে তওবা করো- আন্তরিক তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত’ (সূরা তাহরিম-০৮)।
তওবায় আল্লাহর আনন্দ:কোনো মানুষ যদি পাপের সাগরে নিমজ্জিত থাকে, কলুষ-কালিমায় লিপ্ত থাকে, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। পক্ষান্তরে যখন কোনো ব্যক্তি পাপকর্ম বর্জন করে আল্লাহ তায়ালার দিকে ফিরে আসে, মহান আল্লাহকে স্মরণ করে তার প্রতি মনোযোগী হয় ও কৃত অপকর্মের ব্যাপারে অনুশোচিত হয় এবং তওবা করে তখন আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও আনন্দিত হন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘মনে করো কোনো এক ব্যক্তি সফরের কোনো এক স্থানে অবতরণ করল, সেখানে প্রাণেরও ভয় ছিল। তার সাথে তার সফরের বাহন ছিল। যার ওপর তার খাদ্য ও পানীয় ছিল, সে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল এবং জেগে দেখল তার বাহন চলে গেছে। তখন সে গরমে ও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহ যা চাইলেন তা হলো। তখন সে বলল, আমি যে স্থানে ছিলাম সেখানেই ফিরে যাই। এরপর সে নিজ স্থানে ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর জেগে দেখল, তার বাহনটি তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে ব্যক্তি যতটা খুশি হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার তওবা করার কারণে এর চেয়েও অনেক অধিক খুশি হন’ (বুখারি-৬৩০৮)!
মহানবীর তওবা: বিশ্বনবী সা: নিষ্পাপ ও মাসুম ছিলেন। তার জীবনে কোনো ভুলভ্রান্তি ও অন্যায়-অপরাধ ছিল না। তিনি ছিলেন নিষ্কলঙ্ক ও নিষ্কলুষ। পাপের কালিমায় কলঙ্কিত না হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক তওবা করতেন।
হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও অধিক ইস্তিগফার ও তওবা করে থাকি’ (বুখারি-৬৩০৭)। অন্য আরেকটি হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা: দৈনিক ১০০ বার তওবা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি দৈনিক শতবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তওবা করি’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩৮১৫)। মহানবী সা: সর্বপ্রকার পাপের কলঙ্ক ও কলুষতার কালিমা থেকে মুক্ত থাকা সত্ত্বেও যদি দৈনিক ১০০ বার তওবা করেন, তাহলে আমাদের কতবার তওবা করা উচিত?
তওবাকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন: মানুষের মাধ্যমে গুনাহ-খাতা, ভুল-ভ্রান্তি ও অন্যায়-অপরাধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যার ভুল হয় না। যার দ্বারা অন্যায়-অপরাধ সংঘটিত হয় না। প্রতিটি মানুষই ভুল করে। কিন্তু ভুল করার পর যদি কোনো ব্যক্তি সেই ভুল হতে তওবা করে ফিরে আসে, তা হলে সেই ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন। মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন’ (সূরা বাকারা-২২২)। নিষ্পাপ সমতুল্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি
হাদিস শরিফে পাপীষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্য হতে যারা তওবা করে তাদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত আনাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে তওবাকারীরা উত্তম’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪২৫১)। অন্য আরেকটি হাদিসে গুনাহগার তওবাকারী ব্যক্তিকে নিষ্পাপ মানুষের সমান্তরালে দাঁড় করানো হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসঊদ রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘গুনাহ থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তিতুল্য’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪২৫০)।
ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি: নিজের পাপের পাহাড় দেখে অনেক সময় মানুষ হতাশ ও নিরাশ হয়। ভেবে বসে, আমাকে কি আল্লাহ তায়ালা কখনো ক্ষমা করবেন? আমি কি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য? এই হতাশা ও নিরাশা শয়তানের ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, একজন মানুষের পাপ আল্লাহ তায়ালার রহমতের মোকাবেলায় একটি বালুকণার সমতুল্যও হতে পারে না। মহান আল্লাহর অপার অসীম দয়া ও করুণার তুলনায় মানুষের পাপ নিতান্ত নগণ্য। তাই নিজের ক্ষমা প্রাপ্তির ব্যাপারে হতাশ বা নিরাশ না হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজের বান্দারদেরকে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। তিনি লোকদেরকে হতাশ হতে বারণ করে বলেছেন- ‘হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা জুমার-৫৩)।
তওবার সময়: তওবার কোনো সময়সীমা নেই। তওবা করার জন্য আল্লাহ তায়ালার দরজা সব সময় খোলা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেকোনো মুহূর্তে যদি খাঁটি অন্তরে আল্লাহ তায়ালার দরবারে তওবা করা হয়, কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা করা ও তার তওবা কবুল করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। তবে মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি তওবা করে, তাহলে তার তওবা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অবিলম্বে তওবা করে; এরাই হলো সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ। আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার ওপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে, আমি এখন তওবা করছি’ (সূরা নিসা : ১৭-১৮)।
তওবার শর্ত: তওবার শর্ত হলো নিরেট আল্লাহ তায়ালাকে রাজি-খুশি করার জন্য, তাঁর নৈকট্য হাসিল করার জন্য, তার ইবাদত-বন্দেগির তৌফিক পাওয়ার জন্য ও তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার জন্য তওবা করা। ইতঃপূর্বে যে পাপে জড়িত ছিল সেই পাপ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে ফিরে আসার খাঁটি নিয়ত করা। যে অন্যায় ও অপরাধ তার মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে তার প্রতি লজ্জিত ও অনুশোচিত হওয়া এবং মনে মনে আকাক্সক্ষা করা, হায়! যদি আমি এই গুনাহ না করতাম। আমার দ্বারা এমন অপরাধ সংঘটিত না হতো! অপরাধী ব্যক্তি যে অপরাধ আগে করত তা বর্জন করার দৃঢ় সঙ্কল্প করা এবং ভবিষ্যতে এই অন্যায় কাজে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। কারো সম্পদ আত্মসাৎ করে থাকলে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে আত্মসাৎকৃত সম্পদ সংশ্লিষ্ট মালিককে ফিরিয়ে দেয়া এবং কষ্টদানকৃত ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। হজরত আবু হুরায়রা রা: রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, তার ভাইয়ের পক্ষে তার কাছ থেকে পুণ্য কেটে নেয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে, তা হলে তার মাজলুম ভাইয়ের পাপ এনে তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে’ (বুখারি-৬৫৩৪)।
তওবা করায় ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মঙ্গল নিহিত রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি তওবা করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ইহকালে ক্ষমা করে দেবেন এবং পরকালে নাজাত দান করবেন। তওবাকারী ব্যক্তিদেরকে সফল বলে আখ্যায়িত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’ (সূরা নূর-৩১)। লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া, ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা