গতকাল শুক্রবার ছিল নতুন হিজরি বছরের মহররম মাসের দ্বিতীয় দিন ও প্রথম জুমা। ২১ জুলাই ২০২৩ ইংরেজি, ০৬ শ্রাবণ ১৪৩০ বাংলা, ০২ মহররম ১৪৪৫ হিজরি। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- মহররম মাসের ফজিলত ও করণীয়।
প্রিয় মুসল্লিগণ!
ইসলামি আরবি বর্ষপঞ্জিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পুণ্যময় স্মৃতি। তাই যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের কাছে হিজরি সাল অনেক গুরুত্ব বহন করে আসছে। আল্লাহ তাআলার অপার কৃপায় আমরা ১৪৪৫ হিজরি বর্ষে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ ও কোরবানিসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা কেবল রমজান, ঈদ, কোরবানি ও হজের হিসাব রাখার মধ্যেই যেন সীমিত। আমাদের সন্তানদের বেশির ভাগই তা জানে না যে- হিজরি সাল কী আর আরবি মাসগুলোর নামই বা কী? হিজরি সনের আরবি মাসগুলো- মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জুমাদাল উলা (জমাদিউল আউয়াল), জুমাদাল উখরা (জমাদিউস সানি), রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হিজরি সনের শুভ সূচনা হয়। ইসলামি সন তথা হিজরি সন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনার অবিস্মরণীয় স্মারক। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এটি সম্মানিত ৪ মাসের একটি। আল্লাহর গণনায় মাস ১২টি। এ ১২ মাসের মধ্যে সম্মানিত হারাম মাস ৪টি। যে মাসগুলোতে যাবতীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাতকে মহান আল্লাহ হারাম ঘোষণা করেছেন। তন্মধ্যে মহররম একটি। এটি হিজরি বছরের প্রথম মাস। যা হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রস্তাবনায় হিজরি বছরের প্রথম মাস হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। এ মাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ করো সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা তাওবাহ: আয়াত ৩৬) কোরআনে ঘোষিত সম্মানিত চার নিষিদ্ধ মাস কোনটি? এ সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে-
হজরত আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিনটি হলো ধারাবাহিক মাস- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আর একটি হলো রজব মাস। জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস অর্থাৎ রমজানের আগের মাসের আগের মাস।’ (বুখারি)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
মর্যাদার মাস মহররম। এ মাসের মর্যাদা ও ফজিলত ঘোষণায় হাদিকে পাকে অনেক বর্ণনা রয়েছে। যার কিছু তুলে ধরা হলো- ১. প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা আসমানসমূহ এবং জমিন সৃষ্টির দিন যে আকৃতিতে সময়কে সৃষ্টি করেছিলেন সেটা আবার তার নিজস্ব আকৃতিতে ফিরে এসেছে। আর বারো মাসে এক বছর। তম্মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক। সেগুলো হলো- যুল কাদাহ (জিলকদ), যুল হিজ্জা (জিলহজ) এবং মহররম এবং আরেকটি হল মুযার সম্প্রদায়ের রজব মাস যা জুমাদাল উলা এবং শাবানের মধ্যখানে রয়েছে। (বুখারি ও মুসলিম)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হল আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হল রাতের নামাজ।’ (মুসলিম)
৩. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘জাহেলি যুগে কুরাইশগণ আশুরার রোজা পালন করতো। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে নিজে আশুরারা রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন তা পরিত্যাগ করা হলো। যার ইচ্ছা রাখতো যার ইচ্ছা রাখতো না।’ (বুখারি)
৪. হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা আগমন করার পর দেখলেন, সেখানকার ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কিসের রোজা রাখ? তারা বলল, এটি একটি কল্যাণময় দিন। এ দিন বনি ইসরাইলকে আল্লাহ তাআলা তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই মুসা আলাইহিস সালাম এ দিন রোজা পালন করেছিলেন। (বিধায় আমরাও মুসা আলাইহিস সালামের অনুসরণে এ দিনটিতে রোজা পালন করি)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়ে মুসাকে অনুসরণ করার বেশি হকদার। এরপর তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরকে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি-মুসলিম)
৫. হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনকে ঈদ মনে করতো। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘অতএব তোমরা এ দিন রোজা রাখো।’ (বুখারি-মুসলিম)
৬. হজরত হুমাইদ বিন আব্দুর রহমান হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হজের বছর আশুরার দিন মিম্বারের উঠে বক্তব্য দিতে শুনেছি। তিনি বলছেন, ‘হে মদিনাবাসী, তোমাদের আলেমগণ কোথায়? আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, আজ আশুরার দিন। আল্লাহ এ দিন রোজা রাখা ফরজ করেননি। কিন্তু আমি রোজা রেখেছি। অতএব, তোমাদের কেউ চাইলে রোজা রাখতে পারে, নাও রাখতে পারে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
৭. হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই আশুরার দিনের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে এত গুরুত্ব সহকারে অন্য কোনো দিন রোজা পালন করতে দেখিনি (অর্থাৎ রমজান মাস ছাড়া)।’ (বুখারি)
৮. হজরত রুবাই বিনতে মুআউওয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিন সকাল বেলা আনসারদের মহল্লায় মহল্লায় এ ঘোষণা দেওয়ার জন্য লোক পাঠালেন যে, যে ব্যক্তি রোজা রাখেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ রোজা অবস্থায় থাকে আর যে রোজা রেখেছে সে যেন রোজা পূর্ণ করে। রুবাই রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমরা নিজেরা রোজা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরকে রোজা রাখাতাম। আর তাদের জন্য রঙ্গিন পশম দ্বারা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। কেউ কান্নাকাটি করলে সেটা তাকে দিতাম যেন ইফতারের সময় পর্যন্ত রোজা অবস্থায় থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
৯. হজরত সালামা বিন আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে এ ঘোষণা দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, ‘যে ব্যক্তি খেয়ে ফেলেছে সে যেন দিনের বাকি অংশ রোজা থাকে আর যে খায়নি সেও যেন রোজা অবস্থায় থাকে। কারণ, আজ আশুরার দিন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
১০. হজরত আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ‘প্রতি মাসে তিন দিন এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান পর্যন্ত রোজা রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব অর্জিত হয়। আরাফার দিন রোজা রাখলে আল্লাহর কাছে আশা করি যে তিনি এর বিনিময়ে আগের ও পরের এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেন। আর আশুরার দিন রোজা রাখলে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর বিনিময়ে পূর্বের এক বছরের গুনাহ মোচন করবেন।’ (মুসলিম)
১১. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, জাহেলি জামানার লোকেরা আশুরার দিন রোজা পালন করতো। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানগণও এ দিন রোজা পালন করতেন। পরবর্তীতে রমজানের রোজা ফরজ হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আশুরার দিন আল্লাহ তাআলার দিনসমূহের মধ্য থেকে একটি দিন। যার ইচ্ছা সে এ দিন রোজা রাখতে পারে আর যার ইচ্ছা রোজা বাদও দিতে পারে।’ (মুসলিম)
১২. হজরত জাবির বিন সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের আশুরার দিন রোজা রাখতে আদেশ করতেন, উৎসাহিত করতেন। এমনকি রোজা রাখার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন। এরপর রমজানের রোজা ফরজ হলে তিনি এ রোজার ব্যাপারে আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না এবং এ ব্যাপারে খোঁজ-খবরও নিতেন না।’ (মুসলিম)
১৩. হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আশুরার দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকে রাখার জন্য আদেশ করলেন তখন সাহাবিগণ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এ দিনটিকে তো ইহুদিরা সম্মান করে?! তিনি বললেন, ইন শা আল্লাহ আমি আগামী বছর নয় তারিখে রোজা রাখব।’অন্য বর্ণনায় রয়েছে, (তিনি বলেছেন), ‘আগামীতে বেঁচে থাকলে নয় তারিখে রোজা রাখব।’ (মুসলিম)
১৪. হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আশুরার দিন রোজা রাখ এবং এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের বিরোধিতা করে এর আগের দিন বা পরের দিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদ আহমদ, ইবনে খুযায়মা) হজরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘মাসের শুরু চিনতে অসুবিধা হলে (নয়, দশ ও এগার) এ তিন দিন রোজা রাখবে। যেন নয় ও দশ তারিখে রোজা নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন করা যায়।’ আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হিজরি বছরের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেখানোর তাওফিক দান করুন। মহররমে বেশি নফল ইবাদত ও আশুরায় রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।