আশুরা আরবি শব্দ। আশারাতুন থেকে নির্গত হয়েছে যার অর্থ ১০। আশুরা অর্থ ১০ বা দশম। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কেবল মহররম মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা বলা হয়। এ দিনটি ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময় দিন। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। বহু ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে মহররম মাসের ১০ তারিখে। ইসলামী বর্ষ পরিক্রমায় এ দিন আশুরা নামে অভিহিত। এ দিনে হজরত আদম আ:-এর পৃথিবীতে আগমন এবং তাঁর তাওবাহ কবুল থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হলেও কারবালা প্রান্তরের মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলিম বিশ্ব স্মরণ করে আসছে এবং পবিত্র আশুরা হিসেবে পালন করছে। ধর্মের নামে অধর্ম ও অন্যায়ের অশুভ শক্তি ইসলামের সত্যবাণী ও ন্যায় ধর্মকে আঘাত করা হয়েছিল বলে কারবালার রক্তাক্ত ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল।
ইসলামের চার খলিফার স্বর্ণযুগ অতীত। এজিদ তখন রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। প্রিয় নবীর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন রা: এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। ন্যায় ও সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখায় লক্ষ্যে অবিচল ও আপসহীন থাকায় চাপিয়ে দেয়া হলো এক অসম যুদ্ধ। হজরত ইমাম হোসাইন রা: তাঁর স্বজন ও সহযোদ্ধারা মৃত্যু অবধারিত জেনেও মহানবীর সুমহান আদর্শ রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়ে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে মহান আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনুকরণীয়। তাই পবিত্র আশুরার শিক্ষা হচ্ছে অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত না করা- মিথ্যার কাছে নতি স্বীকার না করা। আজকের এ দিনে প্রকৃত ধার্মিক ও ঈমানদার মুসলমানকে এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে। অন্যায় অসত্য রুখে দাঁড়াতে হবে। সত্যের উজ্জ্বল আলোয় দূর হোক মিথ্যার কালিমা। এটিই হোক আমাদের কামনা ও প্রার্থনা।
ইসলামের ইতিহাসে অনেক তাৎপর্যময় ঘটনাগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে পবিত্র আশুরা। এ দিন কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন রা:-এর শাহাদত হওয়ার কারণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হলেও এ পৃথিবী সৃষ্টি, হজরত ঈসা আ:-কে আসমানে জীবিত অবস্থায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, হজরত আইয়ুব আ:-এর কঠিন রোগ থেকে মুক্তি, হজরত নূহ আ:-এর নৌকা ঝড় তুফানের কবল থেকে মুক্তি পাওয়াসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনায় ভরপুর মহররমের ১০ তারিখ। এ দিনটি মহিমান্বিত ও অবিস্মরণীয়। এ ছাড়া এ পৃথিবীর মহাপ্রলয় রোজ কিয়ামত মহররমের ১০ তারিখ ঘটবে বলে উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন বর্ণনায়। মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন রা:-এর পবিত্র শাহাদতের কারণে শোকের স্মৃতি মুসলিম হৃদয়ে জাগ্রত করে। আশুরার হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণে হিজরি নববর্ষের প্রথম মাস শোক ও বিষাদময় স্মৃতির আবহে আচ্ছাদিত হয়। আরো জানা যায়, এ দিনেই আল্লাহ তায়ালা আদম আ:-কে সৃষ্টি করেছেন এবং এ দিনেই মা হাওয়া আ:-এর সাথে মিলিত হন হজরত আদম আ:। আবার এ দিনেই আল্লাহ তায়ালা আদম আ:-এর তাওবাহ কবুল করেন। এ তারিখেই নূহ আ:-এর জাহাজ জুদি পাহাড়ের প্রান্তরে এসে থেমে যায়। এ দিনেই ইবরাহিম আ:-কে নমরুদ অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করে এবং ইবরাহিম আ: তা থেকে রক্ষা পান। এ দিনেই মূসা আ: বনি ইসরাইলবাসীদের নিয়ে নীল নদ পাড়ি দেন এবং মূসা আ:-কে ধাওয়াকারী ফেরাউন দলবল নিয়ে নীল নদে ডুবে যায়। এ দিনেই ইউনুছ আ: মাছের পেট থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক শোক দিবস শোহাদায়ে কারবালা দিবস। ‘কারবালা’ আজও ঘটে চলেছে দেশে দেশে, দুনিয়ার সব নদ-নদী ‘ফোরাত’-এর কান্না হয়ে বয়ে চলেছে। ‘কুফা’ যেন কুফা হয়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছে মানবসভ্যতার ঘাড়ে মানবাধিকারবি ত প্রতিটি জনপদে। কারবালার শিক্ষা হলো সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন নবীপ্রেম, আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মনিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখের সন্ধান করা। জুলুম ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা, সব সময় আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখা। প্রতিটি মহররম, প্রতিটি আশুরা ও শোহাদায়ে কারবালা দিবস আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে। ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তির পথ তৈরি করাই কারবালার মূল শিক্ষা।
সর্বোপরি ১০ মহররম পৃথিবী ধ্বংস হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র আশুরার রোজা সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত হচ্ছে- শুধু ১০ তারিখে আশুরার রোজা পালন করা জায়েজ রয়েছে। যেহেতু একাকী একটি মাত্র রোজা রাখার ক্ষেত্রে নবী সা:-এর থেকে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা নেই; বরং তিনি নিজেই তা রেখেছেন। তবে বিভিন্ন হাদিসে এটি প্রমাণিত যে, ১০ তারিখের সাথে ৯ তারিখ অথবা ১০ তারিখের সাথে ৯ ও ১১ তারিখসহ মোট তিনটি রোজা পালন করা মুস্তাহাব। আর তা এ জন্যই যে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল সা: যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন তিনি নিজেই আশুরার রোজা রাখেন ও রোজা রাখার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে আদেশ দেন।
তখন সাহাবায়ে কেরাম আপত্তির সূরে বলেন, ওহে নবী! সা: এটি এমন এক দিবস, যে দিবসের প্রতি ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তখন এ দ্বন্দ্ব নিরসনকল্পে রাসূল সা: বলেন, ‘ঠিক আছে, বেঁচে থাকলে মহররমের ৯ তারিখসহ আমরা আগামী বছর রোজা পালন করব-ইনশাআল্লাহ।’ আগামী বছরের আগেই তিনি ইন্তেকাল করায় মহররমের নবম তারিখ রোজা পালনের সুযোগ হয়নি। (মুসলিম) নাইলুল আওতার গ্রন্থে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে মহররমের ৯, ১০, ১১ এ তিন দিন রোজা পালন উত্তম। সুতরাং আশুরার রোজার তিন স্তর- ১. শুধু আশুরার দিন রোজা পালন; ২. নবম ও দশম অথবা ১০, ১১ এ দু’দিন রোজা পালন; ৩. নবম, দশম ও ১১তম দিবসসমূহে ধারাবাহিক তিনটি রোজা পালন। আসুন! হজরত ইমাম হোসাইন রা:-এর শাহাদতের এ দিনে তাঁর আদর্শ হৃদয়ে ধারণ ও লালন করার অঙ্গীকার করি। লেখক : পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়