যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপড়েনের সূচনা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশের আইন প্রয়োগকারী একটি সংস্থার ওপর বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে। সম্পর্কের তিক্ততাকে আরো বাড়িয়ে তোলে জাতীয় নির্বাচন, মানবাধিকারসহ নানা ইস্যুতে দেশটির সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য ও সর্বশেষ গত মে মাসে ঘোষিত ভিসা নীতি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ ভিসা ও আমেরিকান এক্সপ্রেসের মতো মার্কিন কার্ড পেমেন্ট সেবা থেকে বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছিলেন বাজার পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। এর পরিবর্তে চীনা কার্ড পেমেন্ট সেবা ইউনিয়নপের জনপ্রিয়তা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরে দেশে ইউনিয়নপের বাজার সম্প্রসারণ না হয়ে উল্টো সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের ক্রেডিট কার্ডের বাজারে এখনো প্রায় শতভাগ নিয়ন্ত্রণ মার্কিন কার্ড নেটওয়ার্ক ভিসা, মাস্টারকার্ড ও আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স)। ডেবিট কার্ডের বাজারেও রাজত্ব করছে ভিসা ও মাস্টারকার্ড। যে তিনটি ব্যাংক ইউনিয়নপের সঙ্গে চুক্তি করেছে, সেগুলোও এখন চীনা কার্ডটি বাজারজাত করা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে।
চলতি বছরের মে মাসে দেশের বাজারে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকার। এর মধ্যে শুধু ভিসা কার্ডেই ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সে অনুযায়ী এ সময় দেশের বাজারে ক্রেডিট কার্ডে মোট লেনদেনের ৭২ দশমিক ৬৫ শতাংশই হয়েছে ভিসা কার্ডে। মাস্টারকার্ডে লেনদেন ছিল ৩৮৯ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। মোট লেনদেনের ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে আরেক মার্কিন কার্ড অ্যামেক্সের মাধ্যমে। অর্থের পরিমাপে এ লেনদেনের পরিমাণ ২৫৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দেশে ক্রেডিট কার্ডের মোট লেনদেনের ৯৯ দশমিক ৭৭ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করেছে ভিসা, মাস্টারকার্ড ও অ্যামেক্স। গত মে মাসে ইউনিয়নপের মাধ্যমে দেশে মাত্র ৩০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে, শতাংশের হিসাবে যা মোট লেনদেনের দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
বাংলাদেশের বাজার হারালেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনো সম্প্রসারণ হচ্ছে ইউনিয়নপে। মার্কিন কার্ড ও মোবাইল পেমেন্টসংক্রান্ত তথ্য সেবাদাতা প্রকাশনা নিলসন রিপোর্টের ২০২৩ সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বের মোট ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড বাজারের ৩৪ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউনিয়নপের। সর্বোচ্চ ৩৯ শতাংশ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড আছে ভিসার। আর ২৪ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মাস্টারকার্ড। অ্যামেক্সসহ অন্যান্য কার্ডসেবা প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে মাত্র ৩ শতাংশ।
২০১২ সালে বিশ্ববাজারে প্রবেশের পর থেকে ইউনিয়নপের বাজার দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এরই মধ্যে বিশ্বের ১৯১টি দেশে অনুমোদন পেয়েছে চীনা এ কার্ডসেবা। অন্তত ৯৫টি দেশ থেকে ইউনিয়নপের ডেবিট, ক্রেডিট, প্রিপেইড কার্ড ইস্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অন্তত আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইউনিয়নপের ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব স্থাপন হয়েছে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের বিধিনিষেধের মুখে পড়েছে রাশিয়া। এর পর থেকে ভিসা-মাস্টারকার্ডের মতো কার্ড পেমেন্টসেবা ব্যবহার করতে পারছে না রুশ নাগরিকরা। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রাতারাতি চীনের ইউনিয়নপেসেবাকে বেছে নেয় রাশিয়ার আর্থিক খাত। দেশটির বাজারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে ইউনিয়নপে। ২০১৬ সালে দেশে ইউনিয়নপের কার্ড ইস্যু শুরু হয়েছিল বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হাত ধরে। এরপর কার্ড পরিষেবাটির সঙ্গে যুক্ত হয় দ্য সিটি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক। ভিসা-মাস্টারকার্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাজারে ধীরে হলেও সম্প্রসারণ হয়েছিল ইউনিয়নপের বাজার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীনা কার্ডটির বাজার একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক তিনটির ইস্যু করা ইউনিয়নপের কার্ড গ্রাহকরা এখন আর ব্যবহার করছেন না। নতুন করে কোনো গ্রাহক ইউনিয়নপের কার্ড নিতেও রাজি হচ্ছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘?ভিসা-মাস্টারকার্ড যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, ইউনিয়নপে সেটি পায়নি। বর্তমানে ইউনিয়নপের কার্ডের কোনো চাহিদাও নেই। ভিসা ও মাস্টারকার্ড সারা বছরই গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অফার ও সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করে। কিন্তু ইউনিয়নপের সে ধরনের কোনো তৎপরতা নেই। এ কারণে কার্ডটি গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি। আমরা যেসব কার্ড ইস্যু করেছিলাম, সেগুলোও এখন নিষ্ক্রিয়।’
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাওয়া ভিসা কার্ডের যাত্রা ১৯৫৮ সালে। ব্যাংক অব আমেরিকার হাত ধরে শুরু হওয়া আর্থিক সেবাটির বয়স ৬৪ বছরের বেশি। জনপ্রিয় আর্থিক পরিষেবা মাস্টারকার্ডের বয়সও ৫৭ বছর। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কার্ড সেবার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। ভিসা, মাস্টারকার্ড ও আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স) এ তিনটি আর্থিক সেবা বিশ্বের কার্ডভিত্তিক লেনদেনের সিংহভাগ দখলে রেখেছে। তবে এসব কার্ড পরিষেবা চীনের বাজারে অচল। দেশটি নিজেদের জনগণের জন্য ২০০২ সালে চালু করে ইউনিয়নপে। প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের এ দেশের জনগণ বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাপভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা উইচ্যাট এবং ইউনিয়নপে কার্ড ব্যবহার করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত ইউনিয়নপের বাজার শুধু চীনের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই বছর থেকে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে ইউনিয়নপে। এরপর দ্রুতই বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে কার্ডভিত্তিক আর্থিক সেবাটির কার্যক্রম। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পর ২০২০ সালে ইউনিয়নপের সঙ্গে চুক্তি করে দ্য সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। বিশ্বের চারটি প্রধান কার্ড নেটওয়ার্কের সবক’টিই ইস্যু করছে সিটি ব্যাংক। দেশে ক্রেডিট কার্ড বিপণন ও পস মেশিন সরবরাহের দিক থেকে ব্যাংকটির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। ভিসা, মাস্টার ও অ্যামেক্স কার্ড জনপ্রিয় করে তুলতে পারলেও সিটি ব্যাংকের ইউনিয়নপে ব্যর্থ হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা ইউনিয়নপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম সেটি ব্যর্থ হয়েছে। চীনের প্রতিষ্ঠানটি মার্কেটিংয়ের ব্যাকরণ মেনে চলছে না। আমাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির খুব বেশি যোগাযোগও নেই। এ কারণে ইউনিয়নপের কার্ড ইস্যু প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’ তবে ইউনিয়নপে বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মাসুদ রায়হান বলছেন, ?সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির কারণে ইউনিয়নপে বাংলাদেশে সাফল্য পায়নি।
তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নপের ব্যবহার পদ্ধতি, ফি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে কার্ডটি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশের বাজার ভিসা ও মাস্টারকার্ডের নিয়ন্ত্রণে। ভিসার যাবতীয় তৎপরতা ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা ইউনিয়নপেকে জনপ্রিয় করে তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো অনুমোদন করেনি।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত মোট কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৮৩। এর মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩৪। আর ডেবিট কার্ড রয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ ৫ হাজার ৫৭১। এছাড়া ব্যাংকগুলো ৩৮ লাখ ৭০ হাজার ১৭৮টি প্রিপেইড কার্ডও ইস্যু করেছে। ( সূত্র: বণিকবার্তা অনলাইন)