গত কয়েকদিন ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ায় বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলোর ক্ষয়ক্ষতির করুন দৃশ্য। অতি ভারী বৃষ্টি আর পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এবারের আউশ-আমনের ফলন, সবজির আবাদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণি সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এবারের স্মরনকালের ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছ চাষীরা। উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে উপজেলার আনুমানিক ৪ হাজার ৩৭টি পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের। এরমধ্যে ২৭৭ হেক্টর আয়তনের ১৬৩৫টি মজুদ পুকুর ও নার্সারী পুকুরের মাছের ঘেরের সবকটি শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ৪৬৩ টন রুই, কাতল, মৃগেল, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস জাতীয় মাছ এবং পোনা মাছ ভেসে গেছে। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার স্বপন চন্দ্র দে বলেন, পটিয়ায় মাছ চাষ করা হয় এমন জলাশয় আছে আনুমানিক ৮ হাজারের বেশি। বন্যায় প্রায় ৮০ শতাংশ পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ফলে মাছ চাষীদের প্রায় ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মূলত জুলাই-আগস্ট মাস হলো চাষীদের মাছ তোলার পিক টাইম। আগামী মাস থেকে পুকুরে নতুন করে পোনা ছাড়ার কথা। এ অবস্থায় বন্যা হওয়ায় মাছচাষী ও পোনাচাষী উভয়েই বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়েছেন। আমরা উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির বিবরণের রির্পোটটি জেলা অফিসে পাঠিয়েছি। সরকারি ভাবে সহায়তা পাওয়া গেলে আমরা তখন ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিদের কাছে বিতরন করতে পারব। অপরদিকে, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার সতেরটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে প্রায় ১ হাজার ৫৪১ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩১০ হেক্টর আমন ফসল, ৬৭৮ হেক্টর আমন বীজতলা, ৩৪৭ হেক্টর আউশ ফসল এবং ২১৬ হেক্টর সবজির আবাদ। উপজেলা কৃষি কমকর্তা কল্পনা রহমান জানান, কৃষি জমিগুলো থেকে এখনো বন্যার পানি পুরোপুরি নামেনি। ২১৬ হেক্টর সবজির পুরোটাই একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া আউশ ফসলের ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারন করেছে। চলতি মাসের শেষের দিকে এসব ফসল কাটার কথা ছিল। সব মিলিয়ে উপজেলায় কৃষির ক্ষতির পরিমাণ ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা প্রাথমিক ভাবে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৩ লাখ টাকা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬২টি গবাদি পশু ও ২০ হাজার ৫০০টি হাঁস-মুরগী এবং ১২টি খামার। এছাড়াও, নষ্ট হয়েছে ৪ মেট্রিক টন দানাদার খাবার, ১২ মেট্রিক টন শুকনো খড় এবং ৯৫ মেট্রিক টন ঘাস। এতে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, এবারের স্মরনকালের ভয়াবহ বন্যা হওয়ায় খামারিরা একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকে গরু-ছাগল উঁচু জায়গায় নিয়ে যেতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছেন। হাঁস-মুরগি সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না, তাই ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত শুধু খামার গুলোর ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়েছি। এর বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে গবাদি পশু লালন-পালন করে সেসব ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আমরা এখনও জানি না। হিলচিয়া গ্রাম এলাকার কৃষক আবদুল ছবুর বলেন, বন্যার আগেই বীজতলা প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। হালকা বৃষ্টিপাত হওয়ার পর আমন চারা রোপণ শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে সব তলিয়ে গেছে। এখনো পানি নামেনি। নামার পর নতুন করে বীজতলা তৈরি করে চারা রোপণ করব। আমার বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, টানা বৃষ্টি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় যার প্রভাব পড়ে ধানী জমিতে। পাহাড়ি ঢল ও বন্যার পানিতে ডুবে যায় আউশ, আমনের বীজতলা, রোপা আমন ও শরৎকালীন সবজি। খাল ও নদীতে পানি কমার পরও ফসলের জমি এখনো পানিতে ডুবে রয়েছে। এছাড়াও বন্যায় এই তিন খাতের বাইরে সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের আটটি উপজেলায় পটিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর আওতায় ৬ লাখ ৩৪ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছে। টানা বর্ষণে এসব উপজেলা গুলোর অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ বিহীন অন্ধকারে ভয়াবহ বন্যার পানির সাথে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্বাভাবিকভাবে ১৭০ মেগোয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন এই উপজেলা গুলোতে। কিন্তু এর অর্ধেক বিদ্যুৎ ও সরবরাহ করা যাচ্ছেনা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দক্ষিণ চট্টগ্রামে দোহাজারীতে যে গ্রিড সাব-ষ্টেশন রয়েছে এটাও বন্ধ হয়ে গেছে বন্যার কারণে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় এই পর্যন্ত খুঁটি ভেঙে পড়েছে ৪৪টি, খুঁটি পড়ে গেছে ২৩টি, খুঁটি হেলে পড়েছে ৫৪টি, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গেছে ২৭টি, ক্রস আর্ম নষ্ট হয়ে পড়েছে ৬৩টি, ইনসুলেটর নষ্ট হয়েছে ৪৮টি এবং ৪৫২টি স্পটে তার ছিড়ে গেছে। চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ পটিয়ার সিনিয়র জিএম দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, এবারের বন্যায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি পটিয়া -১ এর আনুমানিক প্রায় ৭০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সাতকানিয়া ছাড়া দক্ষিণের সব উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। সাতকানিয়ায়ও কাজ চলছে, দ্রুতই দুই এক দিনের মধ্যে সংযোগ দেয়া যাবে বলে আশা করছি। ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যায় পটিয়ার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত বেশির ভাগ সড়ক পানির নিচে ডুবে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করতে পারেনি এলজিইডি। এর মধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রামীণ সড়ক বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পটিয়া উপজেলা প্রকৌশলী কমল কান্তি পাল বলেন, সড়কগুলোতে এখনো পানি থাকায় এখনও ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র জানা যায়নি। পুরো চিত্র জানতে আরও সময় লাগবে। তবে বন্যায় আমাদের প্রায় ২৫ কিলোমিটার মত গ্রামীন সড়কের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক গুলোতে পানি নেমে গেলে দ্রুত সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটি প্রাথমিকভাবে করা হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড পটিয়ার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অপু দেব দাবি করেন পটিয়াতে এবারের বন্যায় তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রতি বছর ঢলে শ্রীমাই খাল অনেক জায়গায় ভাঙ্গে। কিন্তু এবার খাল খনন করার ফলে তেমন কোথাও ভাঙ্গে নাই। তবে পানির উচ্চতা অনেক বেশ থাকায় অনেক জায়গায় পানি উঠছে। আবার বেড়িবাধ থাকার কারণে অনেক জায়গায় পানি উঠতে পারে নাই বলে দাবি তার।