মানুষের খারাপ স্বভাবগুলোর মধ্যে লোভ অন্যতম। লোভের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- প্রবল আকাক্সক্ষা, ঔৎসুক্য, উন্মুখতা, প্রবলভাবে কামনা করা, প্ররোচনা, প্রলোভন, অতিস্পৃহা, লোলুপতা, প্রলুব্ধ লালসা, মান-সম্মান ও ধনসম্পদের পেছনে ছোটা ইত্যাদি। পরিভাষায় লোভ হচ্ছে- অন্যের মান-সম্মান বা ধনসম্পদ অবৈধভাবে হস্তগত করার চেষ্টা করা। লোভ মানুষকে পাপ কাজে নিয়োজিত করে এবং পাপের পরিণতি হিসেবে আসে মানুষের মরণ। তাই লোভী মানুষ কখনো অল্পে তুষ্ট হয় না। এ কারণে সে পৃথিবীর জীবনে অপমানিত হয় এবং আখিরাতের জীবনে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করে। কেউ কারো কাছে কোনো কিছুর প্রত্যাশী হলে, সে তার তোষামোদ শুরু করে দেয়, যা তাকে শেষ পর্যন্ত মুনাফিকের কাতারে নিয়ে যায়। নিজের সাধুতা প্রচারের জন্য লোক দেখানো ইবাদত করে, যা তাকে রিয়াকারীর দলে ভিড়িয়ে দেয়। আর যার কাছে প্রত্যাশা করা হয়, তার সবধরনের অপমান ও কটুবাক্য অম্লান বদনে সহ্য করে ব্যক্তিত্বহীন হয়ে ওঠে। হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত, খুনখারাবি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানীসহ সবধরনের অনিষ্টের মূলে রয়েছে মানুষের অত্যধিক লোভ-লালসা। এ কারণেই মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা: বলেছেন, ‘তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, এই লোভ-লালসাই তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরের মধ্যে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে। আর এর কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।’ (মুসলিম)
মানুষ যেসব বিষয়ের প্রতি লোভ করে সাধারণভাবে তা হচ্ছে- ১. মান-সম্মান; ২. ক্ষমতা; ৩. ধনসম্পদ। মান-সম্মান ও ক্ষমতার লিপ্সা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের জন্যই ক্ষতিকর। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সা: বলেছেন, ‘ছাগলের পালে দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছেড়ে দিলে যে রকম ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, মান-সম্মানের লিপ্সা ও সম্পদের মোহ মানুষের দ্বীন-ধর্মের জন্য তার চেয়েও অধিক ক্ষতির।’ (তিরমিজি)
ধনসম্পদ আহরণ কোনো দোষের নয়; বরং জীবন ধারণের জন্য অতি আবশ্যক। দোষের হয় তখন যখন অন্যের সম্পদের ওপর লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় এবং অবৈধ উপায়ে তা হস্তগত করার চেষ্টা চালানো হয়। ইসলামে তা সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে- ‘যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কাউকে অপর কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লোভ করো না।’ (৪ : ৩২)
লোভ মানুষের গলায় ফাঁস আর পায়ের শৃঙ্খলস্বরূপ। লোভীরা সবসময় মানসিক যাতনায় ভোগে। কখনোই তারা মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করে না। এ কারণে নবী করিম সা: লোভ-লালসাকে সর্বদা দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার উপকরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ঈমান এবং লোভ এক অন্তরে একত্রিত হতে পারে না।’ ঈমান মানুষের মনে তৃপ্তি এনে দেয়। নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষা দেয়। আর লোভ মানুষকে সবসময় অধিক প্রাপ্তির নেশায় বিভোর করে রাখে, না পাওয়ার যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রাখে। ক্ষমতা ও ধনসম্পদের প্রতি অত্যধিক স্পৃহা মানুষকে কিভাবে পৃথিবীর জীবনে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করছে তা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। লোভীরা যে কেবল অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়, তা নয়। তারা কোনো কিছু ভোগও করতে পারে না। কারণ লোভীরা সাধারণত কৃপণও হয়। ভোগের দ্বারা সম্পদ কমে যাবে এই ভয়ে তারা কোনো কিছু স্বাধীনভাবে ভোগ করার প্রবণতাও হারিয়ে ফেলে। তারা কোনোরূপ দান-খয়রাত এবং জনহিতকর কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারা সবসময় মান-সম্মান ও সম্পদ কমে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। লোভীরা সবসময় মানসিক যাতনায় থাকে। সম্পদ কমে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন তাদেরকে পীড়া দেয়, তেমনি তারা অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। তাই লোভীরা কখনো শান্তি পায় না। শান্তি সবসময় তাদের নাগালের বাইরে থাকে।
অপর দিকে যারা অল্পে তুষ্ট থাকে, অশান্তি তাদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। নিজ মেধা, মনন ও শ্রম দিয়ে বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ তা যত কমই হোক না কেন, তার তৃপ্তি আলাদা ও তুলনাহীন। অপর দিকে লোভাতুর ব্যক্তির অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ তা যত বেশিই হোক না কেন, তা কেবল তার যাতনা ও অশান্তিই বাড়ায়। সর্বশেষ এই লোভ তাকে দুনিয়ার জীবনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আর আখিরাতের জীবনে চিরস্থায়ী শাস্তির ঠিকানা পাইয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সা: বলেছেন, ‘এই উম্মতের প্রথম সফলতা আসছে বিশ্বাস, প্রচেষ্টা ও নিরাসক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর তাদের প্রথম ধ্বংস আসছে কৃপণতা ও লোভের মধ্য দিয়ে।’ (বায়হাকি) মানুষের সম্পদ যত বেশিই হোক না কেন তার ভোগের পরিমাণ কিন্তু সীমিত। ক্ষুধা নিবারণ, আবাসন ও পোশাক-পরিচ্ছদের জন্য খুব বেশি সম্পদের প্রয়োজন হয় না। এতটুকু সে ভোগ করতে পারে, যতটুকু দ্বারা তার ক্ষুধা নিবারণ হয়, দেহ আবৃত হয়, বিশ্রামের জায়গা হয়। এ ছাড়া মানুষের পৃথিবীর জীবনটাও তো অতি ক্ষুদ্র, সামান্য কয়েক দিনের পরিভ্রমণ। তাই অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের হিসাবের তালিকা বাড়িয়ে লাভ কী?
হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমাকে সমস্ত জগৎ দান করলেও তুমি ওই পরিমাণই ভোগ করতে পারবে যা দিয়ে তোমার ক্ষুধা নিবারণ হয়। এ অবস্থায় আমি যদি তোমাকে ক্ষুধা নিবৃত্তি করার উপযোগী সম্পদ দান করি এবং অতিরিক্ত সম্পদের হিসাবের ঝামেলা অপরের ওপর অর্পণ করি তবে এর অধিক তোমার আর কী উপকার করবে।’ ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ বচনটি উচ্চারণের সাথে সাথেই মানবমনে লোভের একটি বীভৎস ও বিভীষিকাময় চেহারা ভেসে ওঠে। মানুষের অতিরিক্ত লোভ ক্ষতি, কষ্ট ও পাপ ছাড়া আর কিছুই দেয় না। অপর দিকে পরিতুষ্টির মধ্যে রয়েছে অনাবিল প্রশান্তি। লোভ পরিতুষ্টির বিপরীত শব্দ। যেহেতু লোভ মানুষকে কোনো কিছুতে তুষ্ট করতে পারে না, সেহেতু লোভ মানুষকে কখনো শান্তি দিতে পারে না। অধিক পাওয়ার অশান্তির অনল তাকে সবসময় দাহ করে। লোভতাড়িত চাহিদা কখনো সৎপথে নিবারণ হয় না। তাই লোভীরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে অসৎ তথা পাপের পথে ধাবিত হতে থাকে।
ইমাম গাজ্জালি রহ: অন্যান্য নিকৃষ্ট স্বাভাবের মতো লোভ দমনেরও কয়েকটি পথ দেখিয়েছেন। সহিঞ্চুতার তিক্ততা, ইলমের মিষ্টতা ও আমলের কষ্টের মিশ্রণে যে মিক্সার প্রস্তুত হয় এটিকেই তিনি লোভ-লালসার মহৌষধ বলেছেন। জাঁকজমকের সাথে ব্যয় বৃদ্ধি না করে নিজেদের যা আছে তাতে তৃপ্ত থাকাই হচ্ছে লোভ দমনের সহজ পথ। মিতব্যয় লোভ-লালসা দমনের আরেকটি সহায়ক উপাদান। জাঁকজমক পরিহার, মিতব্যয় অবলম্বন মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ হওয়া থেকেও রক্ষা করে। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে পরমুখাপেক্ষী করেন না এবং যে ব্যক্তি অতিরিক্ত খরচ করে, সে অভাবগ্রস্ত থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ রাখে, তিনি তাকে ভালোবাসেন।’
ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাকুল না হওয়া লোভ দমনের আরেকটি উপায়। মানবজীবন এত অনিশ্চিত ও ক্ষণস্থায়ী যে, সে জানে না আগামীকাল সে বাঁচবে কি না। তাই আজ লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের পেছনে ছোটাছুটি করে মনোকষ্টে জর্জরিত হওয়ার চেয়ে আগামীকাল উপোস থাকা শ্রেয়। ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে বর্তমানে মনোকষ্টে ভোগা কিংবা মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, কপটতা, শত্রুতা ও ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হওয়া শয়তানের প্ররোচনা ভিন্ন আর কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং কুকর্মের আদেশ করে।’ (২ : ৩৭)
লোভ দমনের আরেকটি সহজ উপায় হচ্ছে উপরের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকানো। কারো জৌলুশপূর্ণ বিলাসী জীবন দেখে লোভ হলে, যারা দারিদ্রের কশাঘাতে নিষ্পেষিত তাদের দিকে তাকাতে হবে। মনে করতে হবে, তাদের চেয়েও ভালো আছি। কারো ক্ষমতা ও মান-মর্যাদা দেখে লোভ হলে, মনে করতে হবে, আমার চেয়ে তো কম ক্ষমতাসম্পন্ন ও হীন মর্যাদার লোক এ পৃথিবীতে জীবন ধারণ করছে। ধনী হওয়ার লোভ জন্মালে মনে করতে হবে, আমার চেয়েও তো গরিব লোক বেঁচে আছে। মনে রাখতে হবে, লোভের পাগলা ঘোড়াকে কখনো লাগামহীন রাখা যাবে না। তা না হলে এর পদতলে পিষ্ট হয়ে অসহায়ের মতো জীবন দিতে হবে। লেখক : চিকিৎসক-কলামিস্ট